click on images to know more about the Images
উত্তর থেকে দক্ষিণ আর পূর্ব থেকে পশ্চিম------- ভারতের সর্বত্রই চলছে দলিতদের ওপর শোষণ, নির্যাতন, আবার কোথাও কোথাও নিধন প্রক্রিয়াও থাকছে অব্যাহত। উত্তর ভারতে সারা বছরে যত পরিমাণ দলিত নির্যাতন ও নিধন হয়, তা আমাদের বিস্মিত করে। ভাবতে অবাক লাগে ---------- এ কোন দেশ, কোন ভূমি। যে দেশে গৌতম বুদ্ধের মতো মহামানবের জন্ম হয়েছে, সেই দেশে মানবসন্তানদের কী করে এত ঘৃণা করা হয়। যে দেশে সামাজিক ন্যায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোকের জন্ম, সে দেশে দলিতদের ওপর এত অন্যায় কেন? যে দেশে কবীর, লালন, হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ, জ্যোতিরাও, পেরিয়ার রামস্বামী, সাবিত্রীবাই ফুলে প্রমুখদের মতো মহামানব-মানবীদের জন্মভূমি, সেদেশের মাটিতে আজও অস্পৃশ্যতা টিকে থাকে কী করে, তা মেনে নেওয়া যায় না। যে দেশে আম্বেদকরের মতো শ্রেষ্ঠ দলিতপ্রজ্ঞা ও সাম্যবাদী সেনানীর জন্ম, সে দেশের মাটিতে স্বজাতির ওপর শত্রুর এত আক্রমণ, তার উত্তর প্রজন্মরা কী করে মেনে নেয়, তা ভাবা যায় না।
অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে কথাগুলো বলতে হলো। শুধু বলার জন্য বলিনি। আমার বেদনার এই আর্তিমালা পৌঁছে দিতে চাই সুন্দরবন থেকে আন্দামান, দণ্ডকারণ্য থেকে রাজস্থানের ঊষর মরুভূমি, নৈনিতাল থেকে কাশ্মীর। সারাদেশের দলিত সহোদরদের এক ফোঁটা চোখের জল মুছে দেবার ক্ষমতা আমার নেই। আমি এতটাই অজ্ঞ এবং অক্ষম। কিন্তু চিৎকার করে বলতে চাই, দলিতদের ওপর শোষণ-নির্যাতন যেভাবে হচ্ছে, তা অন্যায়, তা কোনোভাবেই ন্যায় নয়। আমি সহোদরদের নিধনে ঘুমোতে পারি না। আমি জেগে থাকতে চাই। পাহাড়া দিতে চাই ভাই-বোনদের রক্ষা করতে। আরও পাহাড়াদার ভাই খুঁজে বেড়াই। এই দুঃসময়ে লাঠিয়াল খুঁজে বেড়াই।
এক বুক কান্না নিয়ে আপনাদের স্মরণ করাতে চাই, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে রাজস্থানের ইন্দ্র মেঘওয়ালের ঘটনা। জালোর জেলার ৯ বছরের এই কিশোরের কী অপরাধ ছিলো,দেশবাসী তা আজও জানতে চাইলো না। দলিত ভারতের ৮৫ শতাংশ নিপীড়িত-নির্যাতিত-অস্পৃশ্যরা প্রায় নিশ্চুপ থাকলো। তেষ্টা নিবারণের জন্য ব্রাহ্মণ শিক্ষকের জলের পাত্র স্পর্শ করার বিষময় ফল কী হলো, তা আমরা দেখলাম। নিরপরাধ এই কিশোরের প্রাণ গেলো তারই শিক্ষকের বেদম প্রহারের ফলে। কিশোরের অপরাধ ছিলো-----------সে দলিত। সে অস্পৃশ্য। তার ছোঁয়া পাত্রের জল ব্রাহ্মণ তথা উচ্চ বর্ণের মানুষদের খাওয়া চলে না। এ ঘোরতর পাপ। সুতরাং, পাপস্খলনের জন্য অস্পৃশ্যদের পিটিয়ে মারলে কোনো দোষ নেই। বরং, শাস্ত্রের বিধান অনুসারে তা পুণ্যের। এমনই পুণ্য ভারত কায়েম করতে চায় উত্তর ভারতের বর্ণবাদীরা।
এই ঘটনার অল্প ক'দিন পরেই আবার রাজস্থানে উচু বর্ণের জলের পাত্র স্পর্শ করার জন্য বেদম মার খেলেন রাজস্থানের জয়সলমীরের একজন দলিত। তার নাম চতুরা রাম। ডিগ্গা গ্রামের একটি চায়ের দোকানে সে জলের পাত্র দেখে জল খেতে এগিয়ে যায় এবং জলের পাত্র স্পর্শ করা মাত্রই একজন উঁচু বর্ণের মানুষ এসে তাকে হাতেনাতে ধরে এবং লোহার রড, লাঠি ইত্যাদি সহযোগে বেদম প্রহার করে। কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে বাড়ি ফেরে সে। এই কদর্ষ ভারত কি আমাদের কাছে গৌরবের হতে পারে? আমাদের কি কোনো কিছু করবার প্রয়াস নেই? আমরা কি এমনই নির্দয়, বধির আর পাথর হয়ে থাকবো? বর্ণ নির্যাতনের এমন উদাহরণ পৃথিবীতে eবিরল।
এসবের আগে ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে উত্তরপ্রদেশে ঘটে গেছে আরও একটি নির্মম ঘটনা। পিলভিটেয় ১৬ বছরের এক দলিত কিশোরীকে ধর্ষণ করে তার গায়ে ডিজেল ঢেলে পুরিয়ে মেরেছে ধর্ষকরা। ১২ দিন ধরে ওই দলিত কিশোরী হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছে। তাকে বাঁচানো যায়নি অবশেষে। উত্তরপ্রদেশে দলিত মা-বোনদের এমন মৃত্যু আকছার ঘটে চলেছে। এই মৃত্যুশয্যা আটকাবার কেউ নেই। আইনের কাছে গেলে কোনো ন্যায় মেলে না। কারণ, আইনের অলিন্দে বসে আছে সব উচ্চ বর্ণের মানুষ। তাদের সবার হাতে রামের ধারালো তরোয়াল। শম্বুকদের গলা কাটতে উদ্যত। এমন মৃত্যু উপত্যকা কি দলিতদের দেশ হতে পারে? দলিতদের এখন এসব ভাববার যথার্থ সময়। আর কত সহ্য করবে ভারতের এইসব ব্রাত্য-শূদ্র-অস্পৃশ্যরা?
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখের আরও একটি কদর্য ঘটনার বলি। কর্ণাটকের হুল্লোরহালি গ্রামের মন্দিরের দেবমূর্তিকে নিয়ে মিছিল বেরোয়, তখন সরলমতির একটি দলিত কিশোর দেবমূর্তিকে স্পর্শ করলে শাস্তি হিসেবে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ কেমন বিচিত্র ভারত! এটাই কি ভারতের ধর্ম সাধনা? আর এই ধর্মের উপাসক হবো আমরা? এত নির্যাতন, এত আঘাত, এত অপমান, তবু কোনোরকম হেলদোল নেই আমাদের। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে উত্তর প্রদেশের আউরিয়া জেলার একটি স্কুলের দশম শ্রেণির একজন ছাত্র,নাম নিখিত দোহরে। মাত্র একটি বানান ভুল করায় শিক্ষকের মারে প্রাণ যায় তার। সামাজিক বিজ্ঞানের পরীক্ষায় সে মাত্র একটি বানানই ভুল লিখেছিলো। ফলে উচ্চ বর্ণের শিক্ষক অশ্বিনী সিং রড ও লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি ভাবে প্রহার করে। সঙ্গে লাথিও। দলিত হয়ে বানান ভুল করার দুঃসাহস ওই শিক্ষক মেনে নিতে পারেননি। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কার এমনই ভয়াবহ-----------যার নিপীড়ন থেকে আজও দলিতদের মুক্তি নেই।
এক সেপ্টেম্বর মাসেই যদি উত্তর ভারতের রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশে দলিতদের ওপর এমন নিষ্পেষণ চলে, তাহলে সহজেই অনুমান করা যায়, উত্তর ভারতের সমস্ত রাজ্যগুলিতে কী পরিমাণ নির্যাতন চলে সারা বছর ধরে। সঙ্গে সারা দেশের হিসাবটাও মাথায় রাখতে হবে আমাদের। এরপরেও আমরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ধর্ম সংস্কৃতিকে দেশে আরও দৃঢ় করতে তাদের সর্বত্র রাজ ক্ষমতায় বসাতে চাইছি। এ যে খাল কেটে কুমির আনার চেয়েও ভয়ংকর!
দলিত নির্যাতনে উত্তর ভারতের জুরি মেলা ভার। তারপরও বলতে চাই, পূর্ব ভারতের যে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই, সেখানেও দলিত নির্যাতন হয়। উত্তর প্রদেশের মতো এত কদর্য এবং লাগাতার দলিত নির্যাতন না হলেও গর্বের বাংলাতেও দলিত নির্যাতন আছে। বাংলার মাটিকে সম্প্রীতির মাটি বলেই সকলে জানে। এত মনীষী, লেখক, শিল্পী, মানবতবাদী, বিপ্লবী, ঋষি প্রমুখ জন্মগ্রহণ, যা ভারতের আর কোনো প্রদেশে নেই। সুতরাং, সারা ভারত জাতপাতে তলিয়ে গেলেও বাংলা ডুববে না --------- এই ছিলো আমাদের ভরসা। কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো বাংলাতেও মাঝে মাঝে অমাবস্যা নামছে। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখের অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মন্দির বাজার থানা এলাকায় 'মানুষের পাশে' নামক একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণ্যবাদী দুষ্কৃতিরা অধ্যাপক সুধাকর সরদারকে চরম ভাবে শারীরিক নিগ্রহ করে। সুধাকর সরদার একজন আম্বেদকরবাদী চিন্তা। তিনি আম্বেকরবাদী সমাজতান্ত্রিক। এই তাঁর অপরাধ। শোনা যায়, তাকে নাকি হত্যার করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। বিভিন্ন মিডিয়ায় এই হামলার ঘটনা দেখে এবং শুনে আমরা বাংলার মানুষ স্তম্ভিত। এমন বাংলাকে সচরাচর দেখে মানুষ অভ্যস্ত নয়। তাহলে কি উত্তর ভারতের বর্ণবাদী প্রভুরা গোপনে গোপনে বাংলাকে উত্তরপ্রদেশ বা গুজরাট বানাতে চাইছে?
এই প্রসঙ্গে আপনাদের আরও জানাই, সাম্প্রতিক বিভিন্ন সংবাদপত্রে আমাদের নজরে এসেছে একটি পরিসংখ্যান। সম্প্রতি 'ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো' রিপোর্ট প্রকাশ করে জানিয়েছে -------------দেশে দলিতদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। ২০২১ সালে তপশিলি জাতিভুক্তদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে ১.২ শতাংশ। এর মধ্যে বেশি অপরাধ সংগঠিত হয়েছে উত্তরপ্রদেশে ২৫.৮২ শতাংশ, রাজস্থানে ১৪.৭ শতাংশ ও মধ্যপ্রদেশে ১৪.১ শতাংশ। তপশিলি উপজাতিদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে ৬.৪ শতাংশ। তারমধ্যে মধ্যপ্রদেশে ২৯.৮ শতাংশ, রাজস্থানে ২৪ শতাংশ ও ওডিশায় ৭.৬ শতাংশ। 'ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো'-এর রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার ছবি পড়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দলিত-আদিবাসীদের অগ্রগতি দেখে আকঙ্কিত হয়ে এধরনের নির্যাতন শুরু করেছে। যেসব দলিতরা দলিত-মুসলিম ঐক্যের কথা শুনলে গেলো গেলো রব তোলেন, তারা এসব দেখে শিক্ষা নিন। আর ভাবুন, ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী ঐক্যকে বিনষ্ট করে আগামীতে কি বিষবৃক্ষ রোপণ করতে চাইছেন।
দেশজুড়ে যেভাবে সাংস্কৃতিক কৌশল আর ফ্যাসিবাদী কায়দায় ব্রাহ্মণ্যবাদীরা দলিত নির্যাতন ও নিধন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে, তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় জোটবাঁধা। নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনে আর বিশেষ কোনো সুফল আসবে না। অধ্যাপক সুধাকরবাবুর ওপর বর্বরোচিত ধর্মান্ধদের আক্রমণ বুঝিয়ে দিলো বাংলাও আর নিরাপদ নয়। কিন্তু বাংলার মানুষের ওপরই নির্ভর করছে মনুবাদীদের আক্রমণ প্রতিহত করার। বেদনার হলেও সত্যি, বাংলার মনুবাদ বিরোধী নেতারা নিজেরাই আত্মদ্বন্দ্বে জর্জরিত। এই সুযোগ হারে হারে কাজে লাগাচ্ছে উত্তর ভারতের বর্ণবাদী শক্তি। চারদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যেভাবে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে, তাতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই একমাত্র পথ। আসুন, সর্বস্তরের মাববতাবাদীরা, দেশে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে ও দলিত নির্যাতন, নিধন বন্ধ করতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলি। শূদ্ররা আর কতদিন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গোলামগিরি করবেন? নিজেদের পিতৃমাতৃ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কাছে ফিরুন। জাতপাত, বিভাজন, বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি দলিত-আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এক সময়ের বহিরাগত আর্য-ব্রাহ্মণরা নিজেদের ক্ষমতায়ন বিকাশ ও রাজক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে বর্ণ বিভাজন, বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, জাতি বিদ্বেষ, সম্প্রদায়গুলির মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। ইতিহাস বিমুখ দলিত-আদিবাসীরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শেকলে বন্দি। দলিতরা শেকল ছেঁড়ার চেষ্টা না করে শেকলকে পুজো করছে। কী আত্মঘাতী জীবনচর্চা!
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রায় চার হাজার বছরের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দলিতদের লড়াই সংগ্রামের অনেক ইতিহাস আছে। অন্তত অখণ্ড ভারতে বাংলার মাটিতে মতুয়াদের লড়াই সংগ্রাম সর্বজনবিদিত ঘটনা। হরি-গুরুচাঁদ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে কখনও মাথা নোয়াননি। সে এক গৌরবময় ইতিহাস। ভাবতে অবাক লাগে,বাংলার সেসব মতুয়ারা আজ গেলো কোথায়? অধ্যাপক সুধাকর সরদারের দুর্দিনে বাংলার আকাশ বাতাস ডঙ্কা-কাশি আর লাল-সাদা পতাকায় কেঁপে যাবার কথা ছিলো। হায় বাংলা, হায় মতুয়া! দাসত্ব মোচন আর ভ্রাতৃহত্যার বদলা নিতে আবার জেগে ওঠো। সূর্য উঠুক। আলো জ্বলুক। ছিন্ন হোক যাবতীয় মনুবাদী শৃঙ্খলা।