click on images to know more about the Images

বিদ্রোহী একলব্য ( একাঙ্ক নাটক )

Author: রাজু দাস

বনাঞ্চলের দৃশ্যপট। একটি উচু টিলার উপরে পদ্মাসনে বসে একলব্য চোখ বন্ধ করে গুরুবন্দনা করছেন। তার দুপাশে দুটি গাছের গুড়ির মতো বসার জায়গা। একটি বাঁশের ধনুক, তুনের মধ্যে তীরসহ ঝোলানো। অন্যপাশে অদৃশ্য দ্রোণাচার্যের মূর্তি। দেখাতে পারলে ভালো। শব্দ আলো পরিচালকের মর্জি মতো।

 

একলব্য : - গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ঞু, গুরু দেব মহেশ্বর, গুরু সাক্ষাৎ পরম ব্রহ্মা, তসমই শ্রীগুরুদেবই নম :

( শ্লোক শেষে মূর্তির পাদদেশে প্রনাম করে উঠতেই দেখেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য )

এ কী বিস্ময় ! এ কাকে দেখছি আমি ! এমনটা যে ঘটতে পারে, তা আমার কল্পনার অতীত।

দ্রোণাচার্য :- মানুষ তো দৃশ্যমান বস্তু ভিন্ন কল্পনা করতে পারে না বৎস ! আমি ভরদ্বাজ মুনির পূত্র অস্ত্রবিশারদ দ্রোণাচার্য।

একলব্য : পাঞ্চাল , হস্তিনাপুর তথা ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ট অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য স্বশরীরে আমার অরণ্যঘেরা পর্ণকুটিরে দন্ডায়মান, এ কী সত্যি ?

দ্রোণাচার্য : হ্যাঁ যুবক সত্যি । নহে স্বপ্ন।

একলব্য : [মাথা ঠেকিয়ে প্রনাম করে ] আসন গ্রহন করুন মহাত্মন।

দ্রোণাচার্য : তুমি যে গুরুবন্দনা করছিলে,সেটি কোন্ গুরুর উদ্দেশ্যে?

একলব্য : আমার প্রথম গুরু জন্মদাত্রী জননী ও জন্মদাতা পিতা। যাদের কৃপায় আমি এই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি, আমি হাটতে, কথা বলতে শিখেছি। তাই ওরা শুধু আমার শিক্ষা গুরু নয়, ওরাই আমার সাক্ষাৎ ঈশ্বর।

দ্রোণাচার্য : কি নাম তোমার পিতার, যিনি এমন বোধসম্পন্ন পূত্রের জন্ম দিয়েছেন ?

একলব্য : নিষাদরাজ হিরণ্যধনু। এই অরন্য রাজ্যের স্বাধীন রাজাধিরাজ। আমি তার একমাত্র সন্তান একলব্য।

দ্রোণাচার্য : একলব্য ! তোমার স্কন্ধে উপবীত না দেখে এবং তোমার কৃষ্ণবর্ণ অবয়ব দেখে আমার পূর্বেই সন্দেহ হয়েছিল তুমি হীনবীর্য নিষাদপূত্র।

একলব্য : নিষাদদের হীনবীর্য বলার মধ্যে তো কোন যুক্তি দেখি না। কারন আমাদের ধংশ করে বা যুদ্ধে পরাজিত করে আমাদের ধনসম্পত্তি ও গোধনকে দেবতাদের হাতে তুলে দেবার জন্যে দেবরাজ ইন্দ্রকে, সূর্যের প্রার্থনা করতে হয়েছিল। আমরাই আর্যদের দখলকৃত রাজ্য বারংবার বিনষ্ট করেছি । আমরা অরণ্যবাসীরা আর্যায়ন বারবার প্রতিরোধ করেছি, তা হলে আমরা কী করে হীনবীর্য হলাম?

দ্রোণাচার্য : থাক থাক। তোমার সাথে আর্য-অনার্যের তর্কযুদ্ধ করতে আমি এই অরণ্যে আসিনি। এসেছিলাম এক অমোঘ তীরন্দাজের সন্ধানে। পথিমধ্যে তোমার পর্ণকুটিরের প্রবেশদ্বারে মৃত্তিকানির্মিত অবিকল আমার প্রতিমূর্তি দেখে ও গুরুবন্দনার সুমধুর স্বর শুনে কৌতূহল দমন করতে। গুরুবন্দনা তো তুমি ভালোই করেছ কিন্তু কে সেই দক্ষ শিল্পী যে এমন সুন্দর

মৃত্শিল্প সৃষ্টি করেছেন?

একলব্য : সেই শিল্পী আমিই গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : ও তুমি ! তুমি আমার মূর্তি তৈরী করেছ কেন ?

একলব্য: আপনি যে আমার শিক্ষাগুরু। তাই তো অস্ত্র চালনা অভ্যাসের পূর্বে প্রতিদিন আপনার মূর্তিঞর পায়ে পুষ্পার্ঘ দিয়ে প্রনাম করি।

দ্রোণাচার্য : কিন্তু আমি তো কোন দিন তোমায় অস্ত্রশিক্ষা দেই নি। তাছাড়া যে কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে মন স্থির রেখে একাগ্রচিত্তে চক্ষু কর্ণকে প্রয়োগ করতে হয়,তা কি তুমি জান?

একলব্য : আমি তো তাই করেছি। আপনি আমাকে দেখতে পান নি গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : অসম্ভব। আমার স্মরণ মননের মতো দৃষ্টিক্ষমতাও প্রখর বলেই আমি মুনিদ্রোণাচার্য ব্রাহ্মণ্যধর্ম পরিত্যাগ করে অস্ত্রশিক্ষা গুরু হতে পেরেছি। সে কথা ভুলো না যুবক !

একলব্য : আমি ভুলিনি গুরুদেব, ভুলেছেন আপনি। ঠিক আছে, সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে আমি আপনাকে সাহায্য করছি। মনে করুন এই স্থানটি আপনার সেই দিনের শিক্ষাশ্রম। কুরু - পান্ডবদের সন্তনসহ আরো অনেক উচ্চবর্ণের শিষ্যরা আপনার চারিদিকে দন্ডায়মান। আপনি এই আসনে বসে উপদেশ দিচ্ছিলেন। আপনার উপদেশ শেষ হলে আমি ষষ্ঠাঙ্গে প্রনাম করে বলেছিলাম- - আমি নিষাদরাজ পূত্র একলব্য। বহু দূর থেকে আপনার কাছে ধর্নুবিদ্যা শিখতে এসেছি।

দ্রোণাচার্য : ধর্নুবিদ্যা শিখতে এসেছো তুমি ! আমার কাছে !

একলব্য : ( জোড়া হাতে ) হ্যাঁ গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : তুমি কি করে জানলে আমি এই অরণ্যভূমিতে শিক্ষাশ্রম করেছি ?

একলব্য : এই ভারতবর্ষে আপনার সুনাম কে না শুনেছেন! আপনি মহর্ষি পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছেন। তাই ধর্নুবিদ্যায় আপনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

দ্রোণাচার্য : বাব্বা, আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেই এসোছ দেখছি, কিন্তু বৎস আমি যে রাজপূত্র ছাড়া অন্য কাউকে অস্ত্রশিক্ষা দিই না।

একলব্য : ক্ষমা করবেন গুরুদেব ! আমি একটু আগেই বলেছি, আমি অরণ্যাধিপতি হিরণ্যধনুর পূত্র একলব্য।

দ্রোণাচার্য : ও বলেছ না কী? খেয়াল করিনি।

একলব্য : বলেছি গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : আচ্ছা তুমি প্রথম থেকে আমাকে গুরুদেব বলে সম্বোধন করছো কেন ? তুমি তো আমার শিষ্য নও !

একলব্য : শিষ্য না হলেও আপনি আমার গুরু। কারন আমি যখন নিষাদ রাজপ্রাসাদের অস্ত্রশিক্ষার পাঠ নিতে শুরু করি তখনই আপনার বীরত্বের কথা প্রথম শুনেছি। সেই থেকে মনে মনে আপনাকে অস্ত্রগুরু হিসাবে মেনে নিয়েছি।

দ্রোণাচার্য : ও তুমি অস্ত্র চালনার প্রাথমিক শিক্ষাও গ্রহণ করেছ তাহলে !

একলব্য : রাজপূত্র না হলেও আমাদের অরণ্যবাসীদের প্রত্যেক ছেলে মেয়েকেই আত্মরক্ষা ও অরণ্যরক্ষার জন্য অস্ত্রশিক্ষা আয়ত্ব করতেই হয়। আমি বেশ কিছুক্ষন আগে থেকে সকলের পেছনে দাঁড়িয়ে আপনার কন্ঠে নানান অস্ত্রচালনা ও আকর - প্রকার সম্পর্কে যে সকল উপদেশ বলছিলেন, তা শুনে বেশ বুঝতে পেরেছি আমার শিক্ষার অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাই আপনি আমাকে কৃপা করে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করুন গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : আমার কৃপাদৃষ্টি তোমার উপর বর্ষিত হবেনা বৎস।

একলব্য : কেন গুরুদেব?

দ্রোণ : আমার হাত পা যে কুরুরাজার কাছে বাঁধা।

একলব্য : আপনার এই পাঠশালায় তো নানা রাজ্যের রাজপুত্ররা পাঠ গ্রহন করছেন তা হলে আমি কেন পাঠ নিতে পারব না ?

দ্রোণাচার্য : শোন একলব্য, আর্যসমাজ চতুবর্ণীয় বিভাজনের অধীনে পরিচালিত। ব্রাহ্মন - ক্ষত্রিয় - বৈশ্য - শূদ্র। এই শ্রেণীপ্রথা সমাজে বিরাজমান না থাকলে আর্যশাসিত সমাজব্যবস্থা কবেই ভেঙ্গে পড়তো। জানতো ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়রা স্বাধীন। তাই ব্রাহ্মণ্যমস্তিস্ক আর ক্ষত্রিয়ের বাহুবলের সম্মিলনে এমন একটা কেন্দ্রশক্তি তৈরী হয়েছে, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বী, অপ্রতিরোধ্য । কাজেই ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়ের সমন্বয়কে অব্যাহত রাখতে হলে ছোটজাতের শূদ্রদের মাথা তুলতে দেওয়া যাবে না।

কারন ক্ষত্রিয়রাজা ও ব্রাহ্মণরা জানে, ব্যাধ - ডোম - নিষাদ - শূদ্রদের মস্তিষ্ক খুব উর্বর। এই উর্বর মস্তিষ্কে যদি আক্ষরিক শিক্ষা, অস্ত্রবিদ্যা আর রণকৌশল ঢুকে যায় তাহলে পৃথিবীকে ওরা একদিন পদানত করে ছাড়বে।

একলব্য : পদানত করে ছাড়বোই তো। আর্যজাতির লোকেরা বিদেশ থেকে এসে শাস্ত্র - অস্ত্র - আর দ্রুতগামী অশ্বের সাহায্যে আর বেশি দিন শূদ্রদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আপনি বেদ - বেদান্তের পন্ডিত, আপনি নিশ্চয়ই জানেন নিষাদ নামের জনগোষ্ঠী মানব সভ্যতার সমবয়সী ? আর্যরা যতই অবহেলা অবজ্ঞা দেখান না কেন, এটা তো আজ সর্বজনস্বীকৃত যে, অনার্যরা ভারতবর্ষের নানা অংশে রাজত্ব করেছেন এবং এখনো করছে। আর্যদের মতো অনার্যদেরও উচ্চমানের শিক্ষা - সংস্কৃতি আছে, ভাববার জন্য উন্নত মস্তিষ্ক আছে, ভালোবাসার জন্য হৃদয় আছে, মানবতাবোধ আছে, যুদ্ধ করার জন্য দৈহিক বল আছে। কঠিন সমরে অস্ত্রধারণ ক্ষমতা আছে। জানা নেই শুধু আর্যদের মতো অস্ত্র চালনার নব নব কৌশল। সেই ঘাটতি পুরনের জন্যেই আমি অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যের কাছে এসেছি। আপনি রাজন্যবর্গের ভয়ে আমাকে নিরাশ করবেন না গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : বা : শাস্ত্র ও সমাজতত্ত বিষয়ে দেখছি একেবারে টনটনে জ্ঞান। তবুও হীন,নীচ বংশে জন্ম তোমার, এ কথা নহেকো অসত্য?

একলব্য : মিথ্যে জাতপাতের দোহাই দিয়ে অধিকাংশ কষ্টজীবী মানুষকে তো আপনারাই বেধে রেখেছেন শোষন শাসনের সুবিধার জন্য।

দ্রোণাচার্য : তোমার প্রলাপ শোনার আর সময় নেই আমার। তুমি এবার বিদায় হও।

একলব্য : গুরু দ্রোণাচার্যের মুখে এ রকম জাতিবিদ্বেষ মূলক বর্ণবাদী প্রলাপ শুনতে হবে তা আমি ভাবতে পারছি না গুরুদেব!

দ্রোণাচার্য : আমি পুনরায় বলছি, আমি মানবশ্রেষ্ট ব্রাহ্মণ হয়ে তোমার মতো নিষাদকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে পারবো না।

তুমি ফিরে যাও একলব্য।

( নতমস্তকে চলে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে )

একলব্য : চলে যাবার আগে আমাকে একটি কথা বলার অনুমতি দেবেন গুরুদেব?

দ্রোণাচার্য : বলো -

একলব্য : একজন ছাত্র ছাত্রীর মধ্যে যদি উদগ্র উচ্চাশা থাকে,যদি সে মেধাবান আর অধ্যাবসায়ী হয়, শুধু তথাকথিত হীনবংশে জন্ম বলে তার উচ্চাশার পুরন হবেনা কেন ? অথচ আপনি আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়ে জাতিগত পেশা পরিবর্তন করে ধর্নুবিদ হলেন কী করে?

দ্রোণাচার্য : একজন ব্রাহ্মণ শাস্ত্রীয় বিধানে যেকোনো পেশা গ্রহণ করতে পারেন। অন্যরা নয়।

একলব্য : মানে যতো কঠোর কঠিন সামাজিক শৃঙ্খল শুধু শূদ্রদের ! বা: বা রে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাস্ত্র বা:।

দ্রোণাচার্য : বহুবছরের প্রচলিত শাস্ত্রীয় প্রথা ভাঙার অধিকার তো আমার নেই একলব্য ! তুমি এবার যাও নইলে অর্জুন তোমাকে ঘাড়ধাক্যা দিয়ে বের করে দিতে বাধ্য হবে। যাও

একলব্য : আমি চলে যাচ্ছি। তবে মনে রাখবেন, আপনার প্রিয় শিষ্য অর্জুনের সাথে আমার দেখা হবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। চলি প্রনাম। ( বীরদর্পে প্রস্হান। ফ্লাস ব্যাক শেষ )

দ্রোণাচার্য : ব্রাহ্মণ্যধর্ম পরিত্যাগ করে আমি কিন্তু অস্ত্রশিক্ষক হতে পেরেছি, সে কথাটা কিন্তু ভুলো না !

একলব্য : আমি কিছুই ভুলিনি , আপনি শুধু একমাত্র অর্জুনেরই গুরুদের। তাই তাকে আপনার সর্ববিদ্যা উজাড় করে দিয়েছেন। এমন কী আপনার একমাত্র পূত্র অশ্বথামার জন্য রক্ষিত অপরাজেয় অস্ত্র তাও আপনি অর্জুনের হাতে তুলে দিয়েছেন !

দ্রোণাচার্য : কেন দেব না ! অর্জুনের মতো গুরুভক্তি পরায়ন ও অধ্যবসায়ী শিষ্য আমি একজনও পাইনি। তাই আমি অর্জুনকে বলেছি - আমি তোমাকে এমন প্রশিক্ষণ দেবো যাতে তুমি হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ট ধণুর্ধর। তৎসামো ভবিতালোকে - যথানান্যো ধনুর্ধর। আমি অর্জুনকে এমন শিক্ষা দিয়েছি, যাতে ও রথ, অস্ব, হস্তী বাহনের ওপর থেকেও শরনিক্ষেপ করতে পারে। এমনকি রথেষু ভূমাবতি চরণ শিক্ষাম শিক্ষয়ৎ ।

একলব্য : আপনি অর্জুনকে যতগুলো অস্ত্র চালনার শিক্ষা দিয়েছেন, আমিও কিন্তু ঐকান্তিক অভ্যাসের দ্বারা ঐ সকল বিদ্যা আয়ত্ব করেছি। শুধু তাই নয় - -

দ্রোণাচার্য : অসম্ভব ! তুমি আমাকে মিথ্যা প্রলাপে বিবশ করতে চাইছো !

একলব্য : তাহলে পরীক্ষা নিন। ঐ দূরের সুউচ্চ বৃক্ষের শাখায় বসে যে কোকিলটা গান গাইছে, আমি চোখ বুজে তাকে বিদ্ধ করবো অথচ সে মরবে না। ( একলব্য ধনুকে তীর সংযোজন করে, হাটুভেঙে দ্রোণাচার্যের সামনে বসে তীর ধনকুকে প্রনাম করে। তারপরে পূর্বের উচুটিলাতে শুয়ে চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় তীর চালায়। সঙ্গে সঙ্গে কোকিলের ডাক বন্ধ হয়ে যায় ]

দ্রোণাচার্য : সাবাশ সাবাশ একলব্য। এসো এসো আমার বক্ষে এসো। সার্থক তোমার অধ্যাবসায় (বুকে জড়িয়ে

ধরে )

একলব্য : আপনার আশীর্বাদেই আমি এই অসাধ্য সাধনে সক্ষম হয়েছি গুরুদেব।

দ্রোণাচার্য : [ ছিটকে সরে গিয়ে ] আ: কেন বার বার একই প্রলাপ বকে আমাকে দুর্বল করছো ! আমি তো তোমাকে কখনো অস্ত্রচালনা শিক্ষা দেইনি ! তবু কেন আমার প্রতিমুর্তিকে প্রনাম জানিয়ে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা দিচ্ছো?

একলব্য : যেদিন আপনি নিষাদ বলে অবহেলায় তাড়িয়ে দিয়ছিলেন, সেই চরম উপেক্ষা আর অপমানই আমাকে বাধ্য করেছে অস্ত্রচালনায় পারদর্শী হতে।

দ্রোণাচার্য : হ্যাঁ মনে পড়ছে, সেদিন তোমার সুঠামগড়ন ও রোদেপোড়া কালোরঙ আর সহজ সরল চোখদুটি দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। সেদিনই বুঝেছিলাম, তোমার দ্বারাই হবে সঠিক অস্ত্রশিক্ষা এবং তুমিই পারবে যতার্থ গুরুর মর্যাদা রক্ষা করতে।

একলব্য : এসব ভাবনার পরেও আপনি কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

দ্রোণাচার্য : সেদিন শাস্ত্র আউড়ে বলেছিলাম -- পন্ঞ্চজন মমহোত্রং জুযধম্ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ও নিষাদ। নিষাদরা শূদ্রবর্ণের চাইতেও অধম। আর্যবসতির বাইরে নিষাদদের বাস।

একলব্য : আমার পিতার গণরাজসভার পন্ডিতাচার্য বলেছিলেন - পুরাণে লেখা আছে নিষাদদের জন্মকথা। অত্যাচারী এক বেনের দক্ষিণ উরু মন্থন করে উৎপন্ন হলো এক কদাকার পুরুষ। ব্রাহ্মণরা তাকে বলল - নিষীদ অর্থাৎ উপবেশন কর। তার থেকেই উৎপন্ন হলো নিষাদ জাতির । আর দক্ষিণ হস্ত মন্থন করে পেলো এক দেবতূল্য পুরুষ , সে হলো পৃথু। এই পৃথুই হলেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম রাজা। একই শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ থেকে উৎপন্ন হলেও তারা তো একই জাতির। আবার রামায়নের কালে দেখি শৃংগবেরপুরের নিষাদরাজ গুহকের সঙ্গে আর্যসভ্যতার ধুরন্ধরপুরুষ রামচন্দ্রের পরম বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল। তাহলে মুনিবর! নিষাদ আর্যদের চাইতে অধম হলো কী প্রকারে ?

দ্রোণাচার্য : বেদ পুরাণ সকল শাস্ত্রই আমি অধ্যায়ন করেছি।

একলব্য : নবগুণে গুণান্বিত ব্রাহ্মণ। এর মধ্যে শিক্ষাদানই প্রধানতম গুণ। তা জেনেও আমাকে শিক্ষা না দিয়ে আপনি ঘোরতর অন্যায় করেছেন।

দ্রোণাচার্য : হ্যাঁ হ্যাঁ আমি অন্যায় করেছি। অর্থোপার্জনের লোভে আমি রাজা ধৃতরাষ্ট্রর দাসত্ব করছি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমি রাজপূত্রদের সাথে তোমাকে শিক্ষা দিতে পারিনি।

একলব্য : সত্যি করে বলুন তো আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আপনার বিবেক দংশন করেনি ?

দ্রোণাচার্য : দারিদ্রের কষাঘাতে যে জর্জরিত তার কাছে বিবেক মৃত। সেই সাথে দ্রূপদরাজার অপমানের জ্বালা আমাকে তিলে তিলে দগ্ধ করছিল।

একলব্য : আমাকে বলুন গুরুদেব, কি সেই ঘটনা ? বলুন ?

দ্রোণাচার্য : একটা সময় অর্থাভাবে আমাদের শিশুসন্তানের মুখে একফোঁটা দুধ জোগাড় করতে না পেরে, অর্থ প্রাপ্তির আশায় মহেন্দ্রপর্বতে সরাসরি পরশুরামের বাসস্থানে গিয়ে উপস্হিত হলাম।

    [ মঞ্চের আর এক জোনে দেখা যাবে, পরশুরাম ও দ্রোণাচার্যকে ]

পরশুরাম : বলো ব্রাহ্মণ কি হেতু আগমন মমালয়ে ?

দ্রোণাচার্য : প্রনমি চরণে আর্য। আমি ঋৃষি ভরদ্বাজের পূত্র। নাম দ্রোণাচার্য। জমদগ্ন নিজে ঋৃষিপূত্র হয়েও অস্ত্রশিক্ষাদানকেই জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছিলেন। আমিও সেই ব্রতকেই গ্রহণ করেছি।

পরশুরাম : আমি অস্ত্রগ্রহণ করেছিলাম, ব্রাহ্মণের অস্তিত্ব রক্ষার্থে। তুমি কেন অস্ত্র শিক্ষাদানে আগ্রহী?

দ্রোণাচার্য : যজন যাজন অপেক্ষা অস্ত্রশিক্ষাদানে উপার্জন অধিক, আমি সম্প্রতি নিদারুণ দারিদ্রের মধ্যে কালাতিপাত করছি। আমি শুনেছি আপনার কাছে প্রচুর ধনভাণ্ডার আছে। তাই অহং ধনম অনন্ত: হি প্রার্থয়ে বিপুল ব্রত। তাই অনন্ত অর্থের সন্ধানে আপনার কাছে এসেছি।

পরশুরাম : দু:খের বিষয় বয়:বৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থের উপকারিতা আমার কাছে হ্রাস হয়ে এসেছে। তাই অধিকাংশ ধনসম্পদ আমি দান করে দিয়েছি। তোমার আসার আগে অন্যান্য অর্থলোভী ব্রাহ্মনেরা আমার শেষ ককপর্দকটি পযর্ন্ত নিয়ে গেছে। এখন তো আমার শরীর ভিন্ন তোমাকে দান করার আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

দ্রোণাচার্য : আচার্য পরশুরাম, আপনার শক্তিশালী মহাঅস্ত্র গুলো তো অর্থলোলুপ কারো কাজে আসবে না। সে গুলো আমাকে দান করুন মহাত্তন।

পরশুরাম : ঠিক আছে, ব্রাহ্মণ হলেও তুমি অস্ত্রবিশারদ। তোমাকেই আমার অস্ত্রগুলো দান করবো। তবে অন্দর মহলে চলো। কিছুদিন এখানে থেকে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণটা শিখে নেবে।

    [ জোন আউট। পূর্বেকার দৃশ্য ]

দ্রোণাচার্য : পরশুরামের মতো বীর যিনি একবিংশতিবার ক্ষত্রিয় হত্যা করেছিলেন একা। এমন অস্ত্রবিদের কাছে ঐ সকল মহাস্ত্রগুলি পেয়ে সারা দেশে আমার যশ ছড়িয়ে পড়ল। সব আর্য অনার্য রাজারাই তাদের পূত্রদের অস্ত্র শিক্ষার জন্য আমার কাছে পাঠাতে লাগলেন। কিন্তু তাতেতো আমাদের অর্থের অভাব মিটলো না।

মনে পড়ল রাজপূত্র দ্রূপদের কথা। গুরুর আশ্রমে অনেক বছর আমরা দুজনে অস্ত্রচালনা শিখেছি। খেলাধুলা থেকে পড়াশুনো পযর্ন্ত কোন ব্যাপারেই ধনী নির্ধন ভেদাভেদের অসমতায় আমাদের সখ্যতা বিব্রত ও কলুষিত হয় নি। সেই বাল্যবন্ধু দ্রুপদ এখন পাঞ্চোলের রাজা হয়েছে। অগাধ ধন সম্পত্তির অধিকারী। তাই স্ত্রী ও পূত্র অশ্বথমাকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হলাম, বাল্যবন্ধুর সকাশে --( জোন পরিবর্তন হবে। রাজপ্রাসাদের দৃশ্যের কিছুটা অবয়ব। রাজসিংহাসনে দ্রুপদ, কিছুটা দূরে দ্রোণাচার্য দন্ডায়মান )

দ্রোণাচার্য : অভিনন্দন দ্রুপদ। ভালো আছো তো সখা ?

দ্রুপদ : কে সখা ! ব্রাহ্মণ, তুমি কাকে সখা বলে সম্বোধন করছো !

দ্রোণাচার্য : কী আশ্চর্য ! তোমার মনে নেই ভরদ্বাজপূত্র এই দ্রোণাচার্যকে !

দ্রুপদ : কোন্ দ্রোণাচার্য ? তোমার সঙ্গে কি আমার আগে কখনো দেখা হয়েছিল !

দ্রোণাচার্য : ( মৃদু হেসে ) ছোটবেলার রসিকতা করার অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারনি দেখছি। বেশ বেশ ।

দ্রুপদ : আমি তোমাকে কিছুতেই চিনতে পারছি না।

দ্রোণাচার্য : হা হা ( উচ্চহাস্য ) আর হেয়ালি কোর না দ্রুপদ। ক্ষুদা তৃষ্ণা পথশ্রমে আমরা ক্লান্ত। আমার স্ত্রী শারদ্বতী কৃপী ও পূত্র অশ্বত্থামা বাইরে অপেক্ষামান। আমরা তোমার আশ্রয়প্রার্থী। রাজসিংহাসন থেকে নেমে এসো সখা, আমি তোমাকে আলিঙ্গন করবো। ( এগোতে থাকে )

দ্রুপদ : থামো ব্রাহ্মণ, আর এগোবে না। যেখানে আছো সেখানেই দন্ডায়মান থাকো।

দ্রোণাচার্য : সখায়াং বিদ্ধি সমিতি। সত্যি মনে নেই সখা?

দ্রুপদ : হা: হা: হা: সখা ! ব্রাহ্মণ তুমি নিতান্তই অশিক্ষিত। তাই তোমার বুদ্ধি পরিপক্ক হয়নি, নইলে কোথায় কি রকম ব্যবহার করতে হয়, কাকে কি সম্বোধন করতে হয়, তাও তুমি শেখনি ব্রাহ্মণ।

দ্রোণাচার্য : গুরুদেব অগ্নিবেশ্যের আশ্রম, প্রতিশ্রুতি সবই ভুলে গেলে দ্রুপদ?

দ্রুপদ : ধরে নিলাম অস্ত্রগুরু ভরদ্বাজ এবং অগ্নিবেশ্যের আশ্রমে আমার কিছুকালব্যাপী থাকা হয়েছিল। ঐ সময় আমাদের দু জনের উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা এবং অবস্থান ছিল তপাশ্রম। কাজেই গূরুগৃহে আমাদের যে সখ্যতা বা বন্ধুত্ব হয়েছিল তার কারণ আশ্রমবাসী ছাত্র হিসেবে আমরা একই অবস্থায় ছিলাম। এখন তোমার উদ্যেশ্য আর আমার লক্ষ্য এক নয়। আমি আজ রাজসিংহাসনে আর তুমি আমার কৃপাপ্রাথী হয়ে দাঁড়িয়ে আছো। শোন দ্রোণাচার্য , সূদীর্ঘ দিনের অদর্শনে পুরাতন বন্ধুত্ব আর থাকে না।

দ্রোণাচার্য : তুমি আমাকে অপমান করছো সখা।

দ্রুপদ : তুমি নিতান্তই নির্বোধ নইলে জানতে, নির্ধন গরিব কখনও ঐশ্বর্যশালীর সখা হতে পারেনা। মূর্খ কখনও পন্ডিতের সখা হতে পারে না। বলহীন কখনো বীরের সখা হয় না। তবুও মানবিক কারনে বলছি- তুমি ইচ্ছে করলে আমার রাজ্যে থেকে যজন যাজন করতে পারো।

দ্রোণাচার্য : তুমি তো জানতে ব্রাহ্মণ্যবৃত্তির প্রতি আমার এতটুকু শ্রদ্ধা ছিল না বলেই আজ আমি অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য হয়েছি। এবার আমি চাই উজ্জ্বল সমৃদ্ধির জীবন। যে জীবনে অর্থ যশ সম্মান ভোগ দাস দাসী হস্তী অশ্ব গাভী রথ থাকবে। তুমি এই সবকিছু দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আমাকে।

দ্রুপদ : কোন প্রতিজ্ঞা, কিসের প্রতিশ্রুতি ? 

দ্রোণাচার্য : গুরুর আশ্রমে তুমি আমাকে স্পর্শ করে বলেছিলে, পাঞ্চালের রাজা হলে তুমি তোমার রাজত্বের অর্ধেক আমাকে দান করবে। আজ তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করো দ্রুপদ।

দ্রুপদ : ( রাগত কন্ঠে ) রাজা নয়, মহাধিপতি নয়, একেবারে দ্রুপদ বলে সম্বোধন ! এই পররাজ্য লোভী কুটিল ব্রাহ্মণের সাহস তো কম নয় ! ঐশ্বর্য নয়, স্বর্ণ নয়, একেবারে বৃহৎ রাজ্যের অর্ধেক রাজ্য চেয়ে বসলে??

দ্রোণাচার্য : চাইতাম না যদি তুমি দেবার প্রতিজ্ঞা না করতে। আজ আমি এসেছি, সেই অধিকার আদায় করতে।

দ্রুপদ : স্তদ্ধ হও উন্মাদ। রাজসভা উন্মাদের জায়গা নয়। তুমি এক্ষুণি রাজসভা ত্যাগ করো, তা না হলে-

দ্রোণাচার্য : তা না হলে কী করবে ! বধ করবে আমাকে ? কারাগারে নিক্ষেপ করবে ! সাহস থাকে তো তাই করো।

দ্রুপদ : তোমার মতো দু কড়ির ব্রাহ্মণকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারি আমি। ভাগ্যিস তোমার ভার্যা এবং পূত্র বাইরে অপেক্ষা করছে। যাও দূর

হও আমার সামনে থেকে।

দ্রোণাচার্য : শুধু রাজসভা থেকে নয়, তোমার পাঞ্চাল থেকেই চলে যাবো আমি। কিন্তু চলে যাবার আগে -

দ্রুপদ : হ্যাঁ হ্যাঁ তাই যাও। আমি তোমার মুখদর্শন করতে চাই না। হ্যাঁ আমি ভিখারীকে ফিরাই না। দানসত্র থেকে দান নিয়ে, পরমান্ন ভক্ষন করে যেও ।

দ্রোণাচির্য : রাজা দ্রুপদ, আজকের অপমান ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা

র শাস্তি যে কি ভয়ংকর হতে পারে তা কিছুদিন পরেই টের পাবে তুমি।

দ্রুপদ : শৃগাল হয়ে ব্যাঘ্রকে ভয় দেখাচ্ছো পামর !

দ্রোণাচার্য : না। সমূদ্র হয়ে ক্ষুদ্র জলাশয়কে ভাসিয়ে দেওয়ার প্রতিঞ্জা করছি। হুতাসন হয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিঞ্জা করছি আমি।

দ্রুপদ : ( দাঁত চেপে মৃদুস্বরে হেসে) হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।

দ্রোণাচার্য : আমি এই পৈতে ছুয়ে প্রতিঞ্জা করছি- আমি পাঞ্চালের রাজধানী ধংস করে তোমাকে আমার এই পায়ের নিচে নিক্ষেপ করবোই করবো।

দ্রুপদ : (অট্টহাসি) তোমার মতো ভিখারির ক্ষমতা কতটুকু, তা আমার জানা আছে । যাও যাও -

দ্রোণাচার্য : ( কাঁধের ধনুকটা ডানহাতে নিয়ে ) এই ধনুক ছুঁয়ে পুনরায় প্রতিজ্ঞা করছি। তোমাকে যুদ্ধে পরাজিত করে আমার পদতলে এনে ফেলে, ঐ পাঞ্চালের রাজসিংহাসনে বসবোই।(প্রস্থান)

দ্রুপদ : যা: যা:। নিছক এককালের সতীর্থ ছিলি তাই তোকে বিনা রক্তপাতে ছেড়ে দিলাম মর্কট।

( পূর্ব জোনে ফিরে আসে একলব্য সহ )

দ্রোণাচার্য : এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার জন্যে আমি কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষকের বৃত্তি গ্রহণ করলাম। উদ্দেশ্য অস্ত্রপারদর্শী শিষ্যদের নিয়ে দ্রুপদকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া। এবার বলতো একলব্য, তুমি কি করে আমার অস্ত্রচালনার কৌশল শিখলে?

একলব্য : হে গুরুদেব, আপনি ভেবেছিলেন - গুরু যাকে কৃপা করে শেখাবে শুধু সেই শিখবে ! নীচু জাতের অজুহাতে যাদের শিক্ষার আঙিনা থেকে তাড়িয়ে দিলেন তারা আর শিখতেই পারবে না। এ সব ব্রাহ্মণদের আহাম্মুকি ছাড়া আর কিছুই নয়। শিক্ষা গ্রহণের অধিকারকে কী জাত দিয়ে বিভাজন করা যায়? অনার্যদের কাছ থেকে আর্যরা কম শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তবে একথা ঠিক আধুনিক অস্ত্রবিদ্যায় আর্যরা নিপুণ। তাই আপনি যখন কৌরব সন্তানদের অস্ত্রশিক্ষা দিতেন, আমি তখন বা কখনো ঝোপঝাড়ের আড়ালে অথবা উচু গাছের ডালে বসে আপনার শিক্ষা পদ্ধতি মনোযোগ সহকারে দেখতাম। ফিরে এসে এই কুটিরে সেই পদ্ধতি অনুশীলন করতাম। এই ভাবে আপনার অজান্তেই আপনি আমাকে শিক্ষা দান করেছেন।

দ্রোণাচার্য : কিন্তু আমি তো অর্জুনকেও শেখাইনি, কী করে রাতের অন্ধকারে অথবা চোখ বন্ধ করে শুধু শব্দ শুনে লক্ষভেদ করা যায়।

একলব্য : না, এই কৌশল হয়তো আপনি নিজেই জানেন না। একদিন গণসভায় আমার পিতা হিরণ্যধনু, অযোধ্যার রাজা দশরথের শব্দভেদীবানের গল্প শুনিয়েছিলেন। কি ভাবে শব্দভেদী হরিনের জলপানের শব্দভ্রমে জলপাত্র ভরার সময় অন্ধমুনীর পূত্র সিন্ধুককে তীরবিদ্ধ করেছিল। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবলাম, তীর নিক্ষেপণে এতো নিপুণতা অর্জন করা যায় ! তাই আমি দীর্ঘ প্রচেষ্টায় সেই ক্ষমতা অর্জন করেছি। আজ আমি মানশ্চক্ষে যে কোন শব্দের উৎপত্তি স্থল দেখতে পাই।

দ্রোণাচার্য : তাহলে তোমার বানেই পান্ডবদের শিকারী কুকুরের মুখ বন্ধ করেছে?

একলব্য : পান্ডবদের কুকুর কি না জানিনা, তবে একটি কুকুরের কন্ঠশ্বর আমার মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল, তাই আমি তার বাকরুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।

দ্রোণাচার্য : আচ্ছা এবার খুলে দাও তো যার মৃদু গোঙানির শব্দ এখনো শোনা যাচ্ছে ।

    ( একলব্য তীর ধনুককে কপালে ঠেকিয়ে ধনুকে তীর সংযোজন করে নিক্ষেপ করে। একটু পরেই কুকুরের গর্জন শোনা যায় )

দ্রোনাচার্য : অভুতপূর্ব তোমার নিপুণতা । আজ আমি নির্দিধায় স্বীকার করছি, তোমার মতো শব্দভেদী বান চালানো আমি ভারতশ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরু হয়েও আয়ত্ব করতে পারিনি। আজ তুমিই প্রমান করলে, নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায় থাকলে যে কেউ, যে কোন জ্ঞান শিক্ষা অর্জণ করতে পারে । আমি তোমাকে আর্শীবাদ করছি একলব্য তুমি দীর্ঘজীবী হও।

একলব্য : এতদিনে গুরুদ্রোণাচার্যের স্বীকৃতি পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। ( প্রনাম করে )

দ্রোণাচার্য : ওঠো প্রিয়তম শিষ্য আমার, তুমি তো জানো গুরুদক্ষিণা না দিলে শিক্ষা সার্থক হয় না !

একলব্য : আপনি আদেশ করুন গুরুদেব। আপনার পরমশত্রু পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ছিন্নশির আপনার পদতলে এনে গুরুদক্ষিনা দিচ্ছি।

দ্রোণাচার্য : না। দ্রুপদ আমার শত্রু। আমিই তাকে শাস্তি দেবো।

একলব্য : তা হলে কী গুরুদক্ষিনা পেলে আপনি সন্তুষ্ট হবেন গুরুদেব?

দ্রোণাচার্য : আমি যা চাইবো, তুমি তাই দেবে তো ! চাওয়ার পরে অপারক বলে পিছিয়ে যাবে না তো?

একলব্য : আমরা অরণ্যবাসীরা কথা দিয়ে কথার খেলাপ করতে জানি না। বলুন কি দক্ষিণা চান আপনি ?

দ্রোণাচার্য : তোমার - তোমার

একলব্য : হ্যাঁ বলুন, কি গুরুদক্ষিনা চান আপনি ?

দ্রোণাচার্য : যদি সন্তোষ করিতে

চাহ গুরুদেবে --

দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধ আঙুলিটা

কাটিয়া দিতে হবে মোরে।

একলব্য : ( বিস্মিত কন্ঠে ) গু রু দে ব !

দ্রোণাচার্য : অর্জুন তাদের কুকুরের মুখ তীরবিদ্ধ দেখে ভীত ও চিন্তিত হয়ে আমাকে ঠগ ও ছলনাকারী বলে ভৎর্সনা করে এবং আরো বলে।

  পূর্বেতে আমার কাছে কৈলা অঙ্গীকার

তব সম প্রিয় শিষ্য নাহিক আমার।।

তোমার সাদৃশ্য বিদ্যা নাহি দিব কারে।

এমন ছলনা প্রভূ করিলা আমারে।।

পৃথিবীতে সেই বিদ্যা অগোচরে নরে।

হেন বিদ্যা শিখাইলে নিষাদ কুমারে।।

অর্জুনের বদ্ধমূল ধারনা সকলের অজ্ঞাতে আমি তোমাকে শব্দভেদী বাণ চালানো শিখিয়েছি। এখন আমি যদি তোমাকে অথর্ব করে না দিতে পারি তাহলে পান্ডবেরা আমাকে হত্যা নয়ত বিতারিত করবেই। কাজেই তোমার বৃদ্ধাঙুলি আমার চাইই চাই। প্রয়োজনে তোমার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেও আমি প্রস্তুত।

একলব্য : আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া মানে, আমার তীর ছোড়া বন্ধ করে দেওয়া। পক্ষান্তরে নিষাদ সন্তান এই একলব্যের সারা জীবনের কষ্ট করে অর্জন করা অস্ত্রবিদ্যা আপনার মতো কুটিল, প্রতারক, স্বার্থবাদি, জাতবিদ্বষী ব্রাহ্মণগুরু দ্রোণাচার্যের চরণে অর্পণ করতে হবে?

দ্রোণাচার্য : হ্যাঁ হ্যাঁ তাই করতে হবে। নইলে ঐ গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অর্জুন তীরবিদ্ধ করে তোমাকে হত্যা করবে । ( একলব্য তড়িৎ গতিতে তীর ধনূক তুলতে চায়, দ্রোণাচার্য পা দিয়ে তীর ধনুক চেপে অথবা জাপটে ধরে ) না না, প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করে কোন লাভ হবে না।

একলব্য : তারমানে ত্রেতাযুগে ব্রাহ্মণের কূ -মন্ত্রনায় আর্যতনয় নারীবিদ্ধেষি রামচন্দ্র যেমন নিরপরাধ অনার্য শম্বুককে হত্যা করেছিল, তেমনি এই দ্বাপরযুগে আর্যসন্তান অর্জুনকে সাথে নিয়ে অনার্য একলব্যকে অক্ষম করার ষড়যন্ত্ করে এসেছেন ! না আমি বিনা যুদ্ধে আমার আঙুল কাটতে দেব না। আমি বুঝেছি অর্জুনকে শ্রেষ্ট ধনুর্ধর বানাতে আমার বুড়ো আঙুল কাটতে এসেছেন।

দ্রোণাচার্য : হ্যাঁ তাই চাই। অর্জুন তীরবিদ্ধ করো এই নিষাদ পূত্রকে ( একলব্য তীরবিদ্ধ হবার মাইম করে। দ্রোণাচর্য পিঠের উপর বসে হাত চেপে বুড়ো আঙুল কেটে নেয় )

একলব্য : বা: বারে গুরু বা:। একদিনের জন্যেও যাকে আপনি নিজেহাতে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেন নি। যে আপনার শিষ্য নয়। অথচ সেই নিষাদের কাছ থেকে নির্লজ্জের মতো গুরুদক্ষিনা চেয়ে নিলেন কী করে? ধিক্ শত ধিক্কার জানাই আপনাকে।

দ্রোণাচার্য : শোন্ তোকে হত্যা করলাম না ইচ্ছে করেই। কারন ব্রাহ্মণের হাতে মারা গেলে তুই স্বর্গে যেতিস। এখন অস্ত্রচর্চা ছেড়ে কৃষিকাজ কর নিশাদ। (প্রস্থান )

একলব্য : ( যন্ত্রণাকাতর কন্ঠে চিৎকার করে ) আর একটা কথা শুনে যাও দ্রোণাচার্য-অর্জুন, তোমরা অনৈতিক ভাবে আমার বুড়ো আঙুল কাটার আগেই আমার অগনিত অনার্য ভাই বোনেদের আমি সমস্ত অস্ত্রচালনা শিখিয়ে দিয়েছি। যাতে তারা একজোট হয়ে পররাজ্যলোভী আর্যদের সবকটি আঙুল কেটে দিতে পারে। সেই দিন আর বেশি দূরে নেই। দুনিয়ার একলব্যরা জাগছে জাগবেই।

== = = = = = = = = =

  নাটকটি লিখতে তথ্যের সাহায্য নিয়েছি : -

রণজিৎ গুহের - মহাভারতের মেধাজীবী।

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর - মহাভারত কথা। এবং প্রশান্ত রায়ের লেখা থেকে।

= = = = = = = 

বিদ্রোহী একলব্যের প্রথম অভিনয়।

কমলাপুর চয়ন তীর্থের মহড়া কক্ষে

           10 ই জুন 2018

নির্দেশনা : চন্দ্রশেখর পোদ্দার।

সাজ সজ্জা : নমিতা দাস

আলো : বাবুলাল দে।

পরিবেশন : শান্তিকুঞ্জ নাটুকে দল

            বিভিন্ন চরিত্রে

একলব্য : চন্দ্রশেখর পোদ্দার

দ্রোণাচার্য : হর্ষবর্দ্ধন চৌধুরী

পরশুরাম : প্রানগোবিন্দ বিশ্বাস / নটরাজ চক্রবর্তী

দ্রুপদ : অমর বিশ্বাস। সুবল দাস

নাটক রচনা ও চিত্রায়ন : রাজু দাস।

উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে ছিলেন :-

ড: অনুপ বিশ্বাস, ড: সুপ্রশান্ত মুখার্জী,

অনিমেষ বালা, হরিপ্রসাদ সরকার, মৃনাল চক্রবর্তী, মৃনাল মন্ডল, সমীর মন্ডল ( ফটোগ্রাফার )।

- - - - - - - -