click on images to know more about the Images
আগের গোটা দিনটাই ছিল মেঘলা। পৌষ মাসের অর্ধেক পেরিয়ে গেছে । এ মাসটাই সাধারণ ভাবে মাঝে মধ্যে মেঘলা আকাশ স্বাভাবিকে দাড়িয়েছে। সদ্য জয়ন্ত এস এস সি উত্তর্ণ মাধ্যমিক স্কুল টিচার হয়েছে। সরকার বাহাদুরের হাজার বেড়াজাল তাকে আটকাতে পারানি। যেভাবেই হোক সেই বেড়াজালের ফাঁকফোকর গলিয়ে শিক্ষকের চাকরিটা এখন প্রায় পাক্কা। তবুও কি যেন একটি সংশোধনযোগ্য কাজে বিকাশ ভবনে যেতে হবে। মসজিদে আজানের পরেই কুয়াশায় ঢাকা ভোর বেলা বলা যায়না একটু রাতেই প্রস্তুত হয়ে চলেগেছে জলঙ্গী বাস স্ট্যান্ডে। মা আগের দিনেই জানত ছেলে কইলকাতা যাবে। এক পহর রাত থাকতেই গরম গরম কি সব খাওয়ার তৈরী করে দিয়েছে। ওতো ভোরে জয়ন্তর খাওয়ার অভ্যাস নেই কোনো দিনিই। তবুও মায়ের মনকে সান্ত্বনা দিতে নাখে মুখে গুজেছে নিয়েছে কিছু। পিতা প্রায়াত হয়েছেন সেই কবে এক দিন দুই রাজনৈতিক দলের বিবাদমান মিছিলের সামনে দিয়ে নেজের প্রতি সৎ বিশ্বাসের উপর আস্তা রেখে যেতে গিয়ে। দুই পক্ষের অতুর্কিত ছোড়া বোমার আঘাতে দেহটা ছিন্নবিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাতে জয়ন্তর পরিবারের কোনো লাভ হয়নি তবে এক দলের আন্দোলনের মক্ষম ইসু হয়ে উঠে ছিল। বাবা যে বছর মারা যান সেই বছর জয়ন্ত মাধ্যমিকের ক্যান্ডিডেট। তখন থেকেই জয়ন্তর কঠিনতম জীবন সংগ্রাম শুরু। মাও স্বামীর মৃত্যুর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে প্রতিশোধের জন্য রাজনীতির ছুমুকে কোনো ভাবেই যেতে দেয়নি ছেলেকে। কি যেন একটা আরাধনা কোম্পানির বাসে চেপেই সিট পেয়ে যায়। বহরমপুর বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে নেমে বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে ধরবে ফার্স্ট প্যাসেঞ্জার। সেই ট্রেনেও একটি বসার সিট পেয়ে যায়। বেলডাঙ্গা স্টেশনে তার পাশ থেকে একজন প্যাসেঞ্জার নেমে পড়ে । জয়ন্তর পাশের সিটটি যথারীতি খালি থাকে। ইতিমধ্যে এক জন তরুণীই বলা যায় কিন্তু যথারীতি সাবালিকা । মানে আঠারো উত্তীর্ণা অবশ্যই মনে হয়। যেন সদ্য ফোটা গোলাপের পাপড়ি গুলি প্রষ্ফুটিত হয়ে সমাপ্ত হয়েছে । গোলাপের মনরমের দিক গুলিতে কোনো রকম ঘাতটি নেই। যেন সদ্য ফোটা সাদা গোলাপ মৌ মৌ করছে। আরও যেনো জয়ন্তর মনে হল এ এক স্বনামধন্য যামিনী পালের হাতের তৈরী সরস্বতী প্রতীমা। তবে বিশেষ আধুনিকা বলে মনে হয়না। এ যেনো ন্যাচারেল বিউটি । আর সব দেহের গড়ন কথা না বললেও পাঠক বর্গের অবশ্যই অনুমিত হবে। স্বাভাবিক ভাবেই পাশের সিট খালি দেখে বসে পড়ে তরুণীটি । ট্রেন বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকে । জয়ন্তর কোনো দিনিই কোনো মেয়ের সঙ্গে আগে গায়ে পড়ে কথা বলা বরাবরেই অভ্যাসের বাইরে । পলাশীতে এক জন মহিলা হাতে একটি ও কোলে করে একটি শিশু নিয়ে মেয়েটির সামনে দাঁড়ায়। জয়ন্ত মনে মনে ইতস্তত করছে নিজে মহিলাটিকে সিটটি ছেড়ে দিলে ভালো হয়। মহিলাটি একটি হৃষ্টপুষ্ট ছেলে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বড়ই কষ্ট হচ্ছে অনুভব করে । এমন কিছু ভাবার আগেই পাশের সেই তরুণীটি সঠাম উঠে মহিলাকে সিটটি ছেড়ে দিল । জয়ন্ত মনে মনে সিটটি ছেড়ে দিয়ে দেশের সব যুবক এক নয় এটা প্রমাণ করতে চেয়ে ছিল। কিন্তু সেটা হাত ছাড়া হল বলা যায়। এমন বিউটির কাছে একটু সমীহ লাভের আশার লোভ কেবা সম্বরণ করতে পারে। সামাজিকতা দেখানোর জন্য এবার তরুণীটিকে নিজে উঠে বসতে বলেন । জয়ন্ত বলে যে, " আমি সেই বহরমপুর থেকে বসে আছি, বসতে পারো "। তরুণীটি বলে, "না থাক থাক দিদি কৃষ্ণনগরে নেমে যাবেন তখন বসবখন "। যাক, এত রূপের লাবণ্যের সঙ্গে কণ্ঠরও যেনো মানানসই আছে । যেনো ককিলকেও হার মানাই বুঝি। কৃষ্ণনগরে ফের তরুণীটি পাশে বসল । তরুণীটি মুখ খোলে জয়ন্তকে উদ্দেশ্য করে , " আপনার কোথায় বাড়ি ?" জয়ন্ত থতমত খেয়ে যায়। সামলে নিয়ে বলে, " জলঙ্গী "। তরুটি বলে, " জলঙ্গীর কোন গ্রামে ?" জয়ন্ত বলে, " দাড়য়ের মাঠ "। তরুণী, " হ্যাঁ দাড়য়ের মাঠ সিপিএমের অনীল বসুর বাড়ি ছিল। আমারও মামার বাড়ি ঐ গ্রামেই "। জয়ন্তর বুকটা যেনো শনশন করে উঠে কেনো বুজতে পারেনা। জয়ন্ত," হ্যাঁ ঠিক তাই "। জয়ন্ত বুকে একটু বল নিয়ে বলে, " তাহলেতো আপনি আমাদের এলাকায় অনেক গিয়েছেন বুছি।" হ্যাঁ অনেক গিয়েছি। আপনি আমাকে আপনি বলে বলছেন কেন, কারণটা না হয় নাই বললাম । তরুণীটি বলে, "ওখানে আগে খুব যেতাম । জলঙ্গীর হাইরোডের পদ্মার ধারের বাঁকে ঘুমন্ত নিরীহ ছাত্রদের পিকনিক করে ফিরে যাওয়ার সময় জলসমাধির জায়গাটার কয়েক বার গিয়ে চোখের জল ফেলে এসেছি। ওখানে এক বনধের দিনে জোড়া বট তলার মোড়ে বিবাদমান সিপিএম কংগ্রেস দলের মিছিলের সামনে নির্দোষ মামার এক বন্ধু, ঘনশ্যামবাবুর দেহটা ছিন্নবিন্ন হয়ে গেল বোমার আঘাতে। সেই সময়েই আমি ওখানেই ছিলাম। মামার মুখে শুনেছিলাম ঘনশ্যাম বাবু মানুষটা নাকি খুব সৎ বিনয়ীও নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন। পেশায় ছিলেন হাতুড়ি ডাক্তার। কিন্ত হামেশায় পাশ দেওয়া ডাক্তারের নাখ কান কাটতেন। এলাকায় নাকি সে ছিলেন একমাত্র গরীবের ডাক্তার। এলাকায় তার ঘনা ডাক্তার বলে পরিচয় ছিল। এলাকার মানুষও তাকে খুব ভালোও বাসত নাকি । আর এই ভালোবাসার নিজের আত্ম বিশ্বাসটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাড়াল। ঐ ডাক্তার বাবু নিজের আত্ম বিশ্বাসের উপর ভর করে মনে করে ছিল মানুষ আমাকে এতো ভালোবাসে তবে নিশ্চয়ই আমি পার্টির মাঝে দাঁড়ালে আজকের বোমা বাজিতে কয়েক জন মানুষের প্রাণ বাঁচাতে পারবে নিশ্চয় । মানুষের প্রাণ বাঁচানোই তার একমাত্র ধর্ম ছিল । কিন্তু ডাক্তার বাবুর এই আত্ম বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল ঐ রাজনৈতিক দলের জিঘাংসা জানমারি বোমারুরা। তারা মানবে কেন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল রাজনৈতিক সার্থ চরিতার্থ করা। তারা যে আসলেই সেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জানমারী। " জয়ন্তর চোখ দুটোর কোন বেয়ে কখন কখন গলিত রজতের নয়ন ধারা রূপালী ধারার মতো গড়িয়ে পড়ে। জয়ন্ত একটি দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে, " হ্যাঁ, ঘনা ডাক্তার বাবু মানে পুরো নাম ঘনশ্যাম চক্রবর্তী হাতুড়ি ডাক্তার। সেয়িই আমার বাবা "। শুনে তরুণীরও চোখে জল চলে আসে মুহূর্তের মধ্যে । মাঝে চা বালা হাঁক দিয়ে উঠে, " চা চায় চায় - লেমনটি, লাগবে নাকি দাদা বোনদের " ? চা বালার হাঁকে নিরবতা ভাঙে উভয়ের। চা বলে জয়ন্ত, "দুটো চা "। আপত্তি করে না তরুণী । অনেক কথা হল নবদের আলা পরিচয়তায়। ট্রেন চলে থামে স্টেশনে স্টেশনে বা ক্রসিং প্রয়োজনে। জয়ন্তর মনে হল যেনো একদিনের পরিচয়েই বহুদিনের পরিচয়। মনে যেনো দোলা দেয় কেমন কেমন। মনে পড়ে মায়ের কথা। মা মাঝে মাধ্যেই বলে থাকে, " বলি বাবা জয়ন্তরে , একটা চাকরি বাকরিতো হল, আর কত দিন মায়ের হাত পুড়াবি। তোর যেমন মনে চাবে তেমনি একটা লক্ষ্ণী নিয়ে আই ঘরে বাবা "। মায়ের কথা যে স্মরণ হয়না তা নয় কিন্তু একাজ সেকাজে সময় হয়ে উঠে লক্ষ্ণী আনার কাজে মন দেওয়ার । আজ হয়তো হয়ে গেছে সেই সময়। ভেবে ভেবে শিহরণ জাগে মনে। তরুণীর মোবাইলে একটি ফোন আসে। ফোনের ভাষায় জয়ন্ত বুঝতে পারে কোন একটা হাসপাতালে ভর্তি আছে বাবা। হার্টের একটি ভাল্প লাগাতে হবে। আলাদা করে জিজ্ঞাসা করতে হলনা তরুণীর বাবার কথা । ফোনের কথা শেষ হলে আরও আলাপে জানতে পারে তরুণী কেন্দ্রীয় সরকারের সিটের পরীক্ষায় ভালো ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে। শুধু ডাকের অপেক্ষায়। এটা রাজ্য সরকারের এস এস সিও নয় যে কাট মানির ঝামেলা আছে। তরুণীর দিদিমনি হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা। ট্রেন চলতেই থাকে ঝিক ঝিক। আজ শিয়ালদা যেনো খুব নিকটেই হয়ে গেল। আর একটু দূর হলে হয়তো আরও ভালো লাগত। পথ যেনো শেষ নাহলে আরও ভালো হত। জয়ন্ত বরাবরেই মুখ চোরা ছেলে। মার ছাড়া কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলাই হয়নি তেমন কোনো দিন । এতো দীর্ঘ আলাপ পরিচয়তার পরেও মনে হল মেয়েটির সঙ্গে তেমন কিছুই কথা বলা হলনা। মায়ের লক্ষ্ণী প্রতীমা যে পেয়ে গেছে সেটাও তরুণীটিকে বলতে পারলনা মুখচোরা জয়ন্ত। শেয়ালদা এসেগেল যে যার ব্যাগ প্যাটরা গোছানোর ধুম লেগে গেল। জয়ন্ত বাঙ্ক থেকে অ্যাটাচিটি পেড়ে হাতে হাতে ধরল। শেয়ালদায় ট্রেন থামলে দুই জনেই এক সঙ্গে উঠা যাক তবে , বলে ট্রেন থেকে নেমে তরুণীটি আগে আগে জয়ন্ত পিছন পিছন হাটতে লাগল, অন্যান্য যাত্রী সহ সারিবদ্ধ ভাবে। ফ্লাটফ্রর্ম পেরিয়ে চলে এল একে বারে বিগ বাজারের নিকটে। যাত্রীর ও গাড়ি যানবাহনের খুব ভীড়ে ঠাঁসা । দাড়ানোর ঠাঁই নেই তিল মাত্র। অ্যারে যা..য়া.. এতক্ষনে মায়ের বাসনার লক্ষ্ণীটির নামেই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। যাকে নিয়ে এতক্ষণ এতো বাসনা এতো জাগরণ এতো উৎসাহ এতো শিহরন এতো আশা। বিদ্যুৎ সকটে সারা রাস্তা শুধুই শিহরণ আর শিহরণ। ভাগ্যিস ততক্ষণও দেখছে তরুণী সামনেই আছে। আরে আরে তোমার নামটিই কি এখনো জিজ্ঞাসা করাই হয়নি, আমি কি অধম একটা! আমার নাম জয়ন্ত চক্রবর্তী। তোমার নামটা ? তরুণী, " আমিওতো তাই বুঝি ! আমার নাম চুমকি দাশ। অমনি মুহূর্তে জয়ন্ত ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে কি দাশ বলে হাত থেকে অ্যাটাচিটি ঠক করে পড়ে যায় রাস্তার কংক্রিটে। চুমকি জাতের বাস্না পেয়ে কোনো উত্তর ইচ্ছা করেই না দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই হারিয়ে গেল গহন ভীড়ের মধ্যে ।