click on images to know more about the Images
পদ্মার অববাহিকা মালিবাড়ি, হুড়শি ও চর কুঠিবাড়ি অঞ্চলে এক বিশাল এলাকা জুড়ে চাঁই নামে এক জনজাতির বাস। এই জনজাতিরিই এক জন খাটি কৃষক ভূষণ চাষার ছেলে শংকর । যার লাঙলের বুকদা জোড়ার ( বলশালি বলদ জোড়া ) দাবনায় কথা বলে শংকরের সুখে দুখে । শাবিত্রীর সই দুই আচলা মস্না আর দুটো নারিকেল পাঠিছে, অমাবস্যা দীপাবলির দিন কয়েক আগেই। দুজনেই দুটো করে ছেলের মা হয়ে গেছে । দুজনেরই এক বছর হেরফেরে বিয়ে । আজ বছর চারেক হয়ে গেল একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত নাই প্রায় সেই বিয়ে থেকেই । শাবিত্রীও সই এর কাছে পিঠে খাওয়ার জন্যে ভাদই ধানের আলো চালের গুড়ো পাঠিয়ে দিয়েছে দিন কয়েক হল । দিয়াড়ার জলময় জলা থেকে বান নেমে যাওয়ার পর নতুন মাটি পড়ে নয়া চর জেগে উঠেছে। চরের নাম আগে থেকেই ছিল নির্মল চর। ওখানে এবার অনেক চাষ যোগ্য জমি জেগে উঠেছে । ভালো উর্বর পলি মাটির রেতি পড়েছে । নিত্য অনাহারের সঙ্গি চোয়াল তোবড়ানো চাষিদের মনে আশার আলো জেগে উঠেছে। আশায় উৎসাহে বুক বাঁধছে । বানের জল নামার পর পরেই কলাই এর ছিটা মেরেছে প্রায় সাত বিঘা জমিতে শংকর । কয়েক বছর থেকে শাল বোনার দামসের ধারে টিনের ছাপরা করে বাস করছিল । সেটাও এবার ভাঙ্গনে ভেঙে গেছে । কপাল ভালো নতুন চর জেগে উঠেছে । এই জেগে উঠা চরে টিনের ছাপরা গেড়েছে অনেকেই তার সঙ্গে শংকরও । নতুন করে বুক বাঁধছে এক সময়ের উত্তাল পদ্মার ঢেউ এর করাল আঘাতে পাতিবোনা কুঠিবাড়ি কাচারী পাড়া সহ অনেক গুলি গ্রাম ভেঙ্গে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় অনাহার অর্ধাহার চাষিরা । সাত বিঘা জমিতে মাসকলায়ের ছিটে মেরেছে শংকর । কলাই এর বিছন কিনেছে শাবিত্রীর গলার তাবিচ কটা বন্ধক দিয়ে । নির্মল চর থেকে প্রায় তিন ক্রোশ রাস্তা কাঁদা জল ভেঙে এসে বনমালির ঘাট। ওখান থেকে প্রাই সাত ক্রোশ রাস্তা হেটে এসে সেখ পাড়ার হাট। শংকর এই হাটেই এসেছে আখের গুড় কিনতে আমাবস্যার রাতে পিঠে করার জন্য । হাটে পাঁচ সাত জনের মত গুড় বিক্রি করতে এসেছিল । চর চত্তের গ্রাম গুলি হল হারু ডাঙা দুর্গা পুর বাঁশগাড়া বডার পাড়া শালবনা রাম নগর জইমুনি পাড়া দামসের ধার ও আরও দশ বারোটা গাঁয়ের মানুষ অমাবস্যার পিঠে করার গুড় কেনার জন্য ঝুকে পড়েছে ভিড় করে । শংকরের কাতারি গুড় বালার দাড়ির নিকটে যেতে না যেতেই গুড় গেল ফুরিয়ে । সব গুড় বালার একই অবস্থা । গুড়তো আর পাওয়া গেল না । তাহলে এখন উপায় কি ! আজকে অমাবস্যার দিনে গুড় না নিয়ে গিয়ে কোনো উপাই নাই । ব্যাটা বেটি দুক্খা আর চমতি হাটে আসার সময় খুব ছিনবিনিয়ে কাঁধতে ছিল বাবার পিছে ধরে আসার জন্য । বুঝিয়ে সুঝিয়ে রেখে এসেছে কোনো মতুনে রাস্তা ঘাট খারাপের দুহাই দিয়ে । শুনলো এক গুড়বালার ঘরে বিক্রির জন্য গুড় আছে । ওর বাড়ি দিগড়ের গ্রাম বাবুলতলিতে । সেখ পাড়া থেকে বাবুল তলি প্রায় চার পাঁচ ক্রোশ দূর উজিয়ই বটে । কি আর করবে উপায়তো নেই । অগত্য যেতেই হলো গুড় বালার পিছন ধরে ওর গাঁয়ে বাবুলতলিতে । গুড় নিয়ে আসার সময় এক ঝলক দেখা করতে হবে বনমালির ঘাটে সরকারের দেওয়া ত্রিপল খাটিয়ে আছে খেন্তি বুড়ি ওর সঙ্গে । আপন কেহু নেই, গাঁ তুতো পিসি বলেই ডাকতো । এই খেন্তি বুড়ি আর শংকরের পরিবার দামসের ধারে এক জায়তেই ছিল। তখন দুধ খাওয়া বয়স থেকেই দুক্খা আর চমতির কত্ত গু মুত ঘেটে কোলে বাদুড় ঝুলা করে পা পা হটি হাটি করে হাটানো শিখিয়েছে । কোনো দিনও একদিনেরও তরে বিন্দুমাত্র বিরক্তি বা আলতি প্রকাশ করেন নাই। বুড়ির তিন কুলে কেহু ছিল না । থাকলেও কেহু কোনো দিন বুড়ির খোজ খবর নিয়েছে বলে কাউকে কোনো দিন দেখেনাই । দুক্খা চমতিকে আপন নাতি নাতনি মতুই ভালো বাসত । বুড়ির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে দেখল যে বুড়ির গা জ্বরে জ্বলে পুড়ে ধিপিয়ে যাচ্ছে । বুড়ির সঙ্গে দেখা করে কথা বলে যখন ঘর ফিরল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে এক পহর রাত হয়ে গেছে । ততক্ষুণে শাবিত্রী নারকেল কুরে মইস্না ভেজে পিষে রেখে দিয়েছে কখনিই । গমের ময়দার তৈরি দিয়াবাতি (প্রদীপ)গুলি পাঁচ পুরিয়া গোঁসায়ের থানে জ্বেলে দিয়ে তেল শেষ হলে সেগুলো আবার নামিয়ে সিদ্ধ করে নিয়ে বসে আছে । শংকরের আসার অপেক্ষায় বসে বসে দেরি দেখে হা হুতাস করছে। ভাবছে দূরের রাস্তা আবার কাঁদা মাটি জলে ভরা কখন কি হয়। শংকরের না ফিরে আসা পর্যন্ত শাবিত্রীর জানে, জান ফিরে আসেনা। দুক্খা ও চমতি বাবার আসার অপেক্ষায় ঝিমুতে ঝিমুতে কখন ঘুম পড়ে গেছে। শাবিত্রী মনে মনে খুব রাগছেও । মনে মনে বলছে আজকে আসুক মিনসে তার পরে দেখাবোক্ষণ কত্ত বড় নিমেন্শা পুরুষ হয়েছে ! আজ একেবারে দেখে ছাড়ব ওর একদিন নাতো আমার একদিন। শংকর ঘর পৌঁচানো মাত্রই , বউ একেবারে ঝিঝিয়ে নিতেই শংকর না রেগে ঠ্যন্ডা মাথায় বিলম্বের সব কথা খুলে বলতেই শাবিত্রীর সব বুঝতে আর বাকি থাকল না। বউ এর সব রাগ ক্রোধ জল হয়ে গেল । খেন্তি বুড়ির জ্ব্যরটা খুব্বি বেশি নাকি সেইটা দুরহিয়ে দুরহিয়ে বার বার বলতে থাকে । বুড়ির জ্বরের কথা ভেবে ভেবে কাজে মন বসেনা আনমনা হয়ে যায়। হাত পা ভারি হয়ে যায়। মনে মনে পস্তায় আহারে বেচারি বুড়হি বলে । এদিকে দুক্খা চমতি পড়শির ঘরে ঘরে দীপাবলির পিঠে দেখে দেখে দাহা পিটে কেঁদে কেঁদে দরজার চৌকাটে পেট পেড়ে কখনি ঘুমিয়ে গেছে । ততোক্ষণে পিঠের জন্য আলো চালের সিদ্ধ করা গরম ময়দাও জুড়িয়ে গেছে । ফের গরম করল । ততোক্ষণে শংকর একটু গুড়ুক গুড়ুক করে হুকোতে তামাক টেনে নিল । তামাক টেনে এসে স্বামী স্ত্রীতে হাতে পাতে পিঠে তৈরি করে এক চাড় পিঠে সিদ্ধ করে নিয়েই, শাবিত্রী প্রথম চাড়ের পিঠে নামিয়েই চট জলদি সঙ্গে সঙ্গে শাবিত্রী বলল যে, "তুমি জলদি জলদি প্রথম চাড়ের পিঠেগুলো খেন্তি পিসিকে দিয়ে এসো , পরের চাড়ের পিঠে নামিয়ে দুক্খা চমতিয়াকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেবক্ষণ " কথা মতন শংকর হাতে কাঁড়ু ধরিয়ে সেই তিন ক্রোশ রাস্তা জল কাঁদা ভেঙে প্রায় শতবার পিচপিচে কাঁদায় পিছলে আছার খেয়ে খেয়ে খেন্তি পিসির কাছে এলো । গায়ে হাত দিয়ে দেখল বুড়ির গায়ে হালি দিয়ে জ্ব্যর এসেছে । ঠর ঠর করে কাঁপছে । পদ্মার ধারের ঠ্যন্ডা হীমেল বাতাসেও গা পুড়ে যাচ্ছে । জ্বরে বিভর হয়ে পড়ে পড়ে কাঁতরাছে । অনেক হাঁক ডাক করে জাগিয়ে শংকর বলে বোড় পিসি এই দেখো তোমার জন্য তোমার শাবি বুহু পিঠে করে পাঠিয়েছে উঠে দুটো খেয়ে নাওতো দেখি আমার সোনা পিশি । খেন্তি বুড়ি জ্বরে ঘোরে বলে যে, "এত্ত রাতে ঠান্ডা হীম বাতাস গায়ে করে রাজ্জির কাঁদা পাঁক ভেঙে এত্ত কষ্ট করে ক্যানো এসেছিস শংকর বেটারে ! সোকাল বেলাই এলেইতো পারতিস সুনা । এই অমাসের ঘন ঘোর রাতে রাস্তায় যুদি কুনু একটা বিপদ আপদ হয়ে যায় তবে আমার শাবি বহুর আর নাবাললোক নাবাললিকা দুক্কা চমতির কি হোবে তোর খিয়াল আছে বেটা ! " শংকর বলে যে , " সব ঠিক আছে তুমি দুইটা পিট্ঠা আগে তুমি খেয়ে লেনতো। তুমি পিট্ঠা না খেলে তোমার আদরের শাবি বুহু কুনু মুতুন পিট্ঠা নাই খাবে " । " তাহইলে পিট্ঠা খাইতেই হোবে ? " দে দেখি একটা পিট্ঠা খাই "। বুড়ির জ্বর হাত থরথ করে কাঁপছে ঠিক মুখে পৌচাচ্ছে না । শংকর একটা পিঠে ভেঙে পিঠের কিছু অংশ বুড়ির মুখে ধরল। বুড়ি পিঠের অংশ বিশেষ থোতলাতে থোতলাতে কোনো মতে খুব জানে পরিষাণ দিয়ে খাওয়ার খুব চেষ্টা করে গেল । কিন্তু খানিকটা গলার ভিতরে গেলো কি না গেলো বেশির ভাগটা উগলে মুখের বাইরে চলে এলো । আর কোনো ভাবেই পেঠে খাওয়ানো সম্ভবিই হল না । একটু কিছু ভাবতে না ভাবতেই সিত্রাং ঘুর্নি ঝড় আঁওদানো ঝটকা বাতাসে এক ঝিটকার ঝটকাতে বুড়ির এক মাত্র মাথার ছাদের ত্রিপলটি উড়িয়ে নিয়ে চলেগেল । শংকর টাল মাটাল সামলে নিথর বুড়ির নাখে হাত দিয়ে দেখল যে গা গরম থাকলেও বুড়ির নাখের বাতাস আর নাই , দেহটা যেনো নিথর পাষাণ হয়ে গেছে । ওর আত্মার প্রাণ বাতাসটা ওর শংকর বেটা শাবি বুহু, দুক্খা, চমতি নাতি নাতনি সকলকেই ছেড় শেষ জীবনের মত ভালোবাসার দুনিয়া ছেড়ে অমর কন্টকে চলেগেছেন । সেই রাতে গোটা চর মহল্লার চরবাসি সকলেই আমাবস্যার পিঠে খেলেও কিন্তু সেই বছরের মতো আমাবশ্যার দীপাবলির পিঠে শংকর আর শাবিত্রীর খাওয়া হয়নি ।