click on images to know more about the Images
গ্রামের তিন কোনা মোড়ের পাশে পরাণের বাড়ি। বাড়ির সামনে সরকারি খাস জমিতে সরাণের ধারে প্রকান্ড একটি পেকড় গাছ। গাছটি প্রকান্ডই বটে কিন্তু গ্রামের মানুষ ছাগল গরুকে পাতা খাওয়ানোর জন্য পেকড় গাছের ছোটো থেকে বড় পর্যন্ত ডাল কেটে মুড়িয়ে দিয়েছে। গাছের জড় গুলি দুর্বল ও কমজোরি হয়ে গিয়েছে। ঐ ভাবেই গ্রামের মহীরূহ দাড়িয়ে ছিল নিজের ক্ষমতায়। বৈশাখের এক বিকাল বেলা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত প্রচন্ড কাল বৈশাখী ঝড়ের প্রকোপে শুকনো মাটি ভিজে নরম হয়ে গেছে। গাছের গোড়া ভিজে মাটির কারণে জড় গুলি আলগা হয়ে গেছে। ফলে লাগাতার প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টিতে মহীরুহটি আকাশ পাতাল কাপিয়ে মড়মড়িয়ে কড়কড়িয়ে উপড়িয়ে ভূপাতিত হল। সেই ভয়াবহ দুর্যোগপূর্ণ রাতে পরানের স্ত্রী দক্ষবালার কোল আলো করে জন্ম হল এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের । প্রথম সন্তান একটা ছেলে হোক সেই আশাটা কার না থাকে?সেই রকম ছেলে হওয়ার আশা বা লোভটা যে পরানের ছিল তা বলা যায়না। কিন্তু ফুটফুটে সুন্দর পাঁকা কমলা লেবুর মতো সদ্য প্রষ্ফুটিত পদ্মর ন্যায় মুখটা চোখে দেখে পরানের ছেলে না হওয়ার দুঃখটা চাপা পড়ে যায় । নাম রাখে বড়ই আদর করে পাপিয়া। সেই রাত্রের পর সকালে সংবাদ শুনে পাড়ার গেঁধু মেম্বার পরানকে আম জাম কাঁঠাল সেগুন শিশু মিলে মোট পাঁচটি চারা গাছ এনে পরানকে দিয়ে বলে যে, " পরান তুমি এই পাঁচটি গাছের চারা তোমার পতিত কোনা বিঘা জমিতে লাগিয়ে দাও । তোমার মেয়ের বয়স যখন হবে কুড়ি বছর তখন গাছ গুলিরও বয়স হবে কুড়ি । তখন তোমার এই গাছ গুলির দাম লাগবে নির্দ্বিধায় লক্ষ টাকা। তাতেই তুমি কন্যা দায় থেকে মুক্ত হয়ে হবে। গ্রামে মেম্বারের সুনামের শেষ ছিল না ।মিষ্টি ভাষ্য ও কঞ্জুস হিসাবে। সে নাকি গ্রামের মানুষকে গায়ের জ্বরও দিতনা।গাছগুলিও দিত না যদি নিজের লাগানোর জমি থাকতো বা স্বজনদের মধ্যে কেউ নিতে চাইতো। পাপিয়ার বয়স যখন দশ বসন্ত পার হল তখন ফলের মরশুমে আম গাছে আম,জাম গাছে জাম, কাঁঠাল গাছে কাঁঠালে পরিপূর্ণ। হাতীর কানের মতো সেগুন গাছের পাতা গুলি বাতাসে ঢেউ খেলত। শিশু গাছের পাতা গুলি বাতাসের স্রোতে সনসনিয়ে পতপতিয়ে কেমন যেন নাম না জানা সুমধুর সুর তুলে। কত্ত রকমের পাখ পাখালি টুকটুকে পাঁকা আম জাম খায় আর কূজন তুলে নিজেদের ভাষায় । শব্দ পেলেই সেগুন শিশু গাছের মগ ডালে গিয়ে বসে। হুনুমান পাঁকা কাঁঠাল গাছেই ফাসিয়ে খায় আর আনন্দে বীরেরা লেজ দুলিয়ে আর মাদিরা বুকে বাচ্চা নিয়ে মহা আনন্দে খেলে বেড়ায় গাছে গাছে । এসব পাপিয়া দূর থেকে দেখে আর আনন্দে হুলসিয়ে পড়ে। পাপিয়ার বয়স যখন বিশ বসন্ত তখন গ্রামের কুটিলরা কুদৃষ্টি দিয়ে বলে " পরানের মেয়ে এখন কুড়ির পরে বুড়ি হয়ে গেল যে। ছুড়ির বিয়ে এখন অধরা, এখন দোজ বরের অপেক্ষায় থাকতে হবে যে ! মেয়ের রূপ নিয়ে পরাণের অহঙ্কার ছিল বটে। না হয় মেয়েটি একটু রূপবতী ছিলুইবা, হায়রে পরান!" বিয়ের বিষয়ে পরাণের বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। কারণ পাপিয়া গাছে গাছে খেলা করে। গাছে গাছে বসা বিভিন্ন রং এর পাখির ডাক নকল করে পাখিদের সঙ্গে অভিনয় করে কথা বলে। পাখিদের বাসা বানানোর জন্য দই এর ভাড় টাঙিয়ে দেয় ডালে ডালে। পাখিদের জল খাওয়ার জন্য জল ভরা ছোটো কৌটাও টাঙিয়ে দেয় শাখা প্রশাখায়। বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় বিদ্যালয়েও যায় নিত্যদিন। বাবা বিয়ের কথা তুললেই লজ্জায় ছোটো হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরাণ ভাবতেও পারেনা বুক খালি করে বিয়ে দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠাতে। ভাবলেই যেন বুকটা হুহু করে উঠে। এই ভাবেই কবে কবে মেয়ের বয়স কুড়ি পার হয়ে গেছে ভিতর ভিতর অজান্তেই। বর্তমানে পাড়ার কুটিলদের গঞ্জনার ভয়ে পরান এখন তেমন বাড়ি থেকে বের হয় না। একদিন এই গঞ্জনীদের মুখে ছাই দিয়ে একুশ বসন্তে বিয়ে ঠিক হয় পাপিয়ার লক্ষ টাকা কন্যাপণে। সেই মতো লক্ষ টাকায় গাছ বায়না হয়ে যায় । পরানের মেয়ের জন্মদিনে লাগানো সেই গাছ গুলি বায়না করে মুসলদারেরা গাছ কাটতে আসে কুড়ল নিয়ে । পাপিয়ার চোখ জলে ভরে যায়। পাপিয়ার বয়সের গাছ গুলি পাপিয়ার ভাই বোনের মত পরম আত্মীয়র মতো হয়ে গেছে কবে অজান্তেই । যেই গাছে কুড়ল মারতে যায় সেই গাছটাকেই পরম স্নেহ জনের মত করে জড়িয়ে ধরে পাপিয়া। কিছুতেই জীবন থাকতে গাছে কুড়ল মারতে দেব না এই তার পণ। গাছ কাটা আর হল না। গাছের বায়না ফেরত হয়ে গেল। পরান লক্ষ টাকার কন্যাপণ আর কোথায় পাবে। বিয়ে গেল ভেঙ্গে। পরাণের মস্তকে বাজ পড়ল। পরানের যেনো কন্যা দায়ে মুক্ত হয়ে উঠার উঁচু মাথা হেঁট হয়েগেল। পরান মহাভাবনায় পড়ে গেলো। এই সংবাদ চারিদিকে চাউরও হয়ে গেল। বরও খুব মানবিক দৃষ্টিতে লজ্জিত হল। বরের নাম বেচারাম। বেচারাম মানবিক দৃষ্টিতে ভাবল আমি কি আজ সত্যই কন্যাপণ নিয়ে বেচা রাম হতে চলে ছিলাম ? একদিন বেচারাম বর সেজে পাপিয়ার কাছে গিয়ে, পাপিয়ার হাত দুটি জড়িয়ে ধরে বলল , " চলো পাপিয়া, আমাদের ছান্নাতলা হোক তোমার ঐ বৃক্ষতলায় "।