click on images to know more about the Images

ভাড়ার পুরুত

Author: নলিনী রঞ্জন মন্ডল

ডাঃ প্রদীপ কুমার বর্মণের কাহিনী সূত্র থেকে মঞ্চ নাটক-

ভাড়ার পুরুত

নলিনী রঞ্জন মণ্ডল

 

-ঃ চরিত্র ঃ-

সূধাময়ী- গৃহকর্ত্রী, প্রণব- ঐ পুত্র, নিবারণ- পুরোহিত, সুবোধ- ভাড়ার পুরোহিত ও ঘোষক ।

 

এক

ঘোষক- নমস্কার । আমাদের সমাজ আজ অতিমাত্রায় কুসংস্কারে জারিত । অনেকে জানি- তা 

  কাদের দোষে । আবার কেউ কেউ ধর্মের ভয়ে জানতে চাই না । বিবেক-জাগ্রত করতে  

  সবার জানা উচিত । আজকের এই নাটকের কাহিনী বেশ কিছু বছরের পুরানো ঘটনা ।  

  আপনাদের জ্ঞাতার্থে পরিবেশিত হচ্ছে । তাহলে দেখতে থাকুন নাটক ভাড়ার পুরুত ।

(পর্দা উঠতেই দেখা যায়- সূধাময়ীর বাড়ির বারান্দা । প্রণব চৌকিতে বসে বই পড়ছে)

প্রণব- সমগ্র গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র মিলিয়ে এই সৌরজগৎ । এর একমাত্র চালিকা শক্তি সূর্য । তাই 

    সূর্যকে বলা হয়- বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ শক্তিধর । এরই নাম প্রাকৃতিক শক্তি ।

(একটা খালি ফুলের সাজি নিয়ে সূধাময়ী আসে)

সূধাময়ী- খোকা । তোর দিদি কোথায় গেল রে ?

প্রণব- জানি না তো ! কেন মা, কী হয়েছে ?

সূধাময়ী- এই সাজিটা খুঁজছিল । তাই-

প্রণব- হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমাকেও জিজ্ঞেস করছিল । এটা কোথায় ছিল ? 

সূধাময়ী- ঘরেই ছিল । লক্ষ্মীপুজোর জন্য মেজে-ধুয়ে তুলে রেখেছি । আজ লাগবে । শুদ্ধাচারে 

  পূজার্চনা করলে সংসারে ধন-সম্পদ বাড়ে ।

প্রণব- কিন্তু মা, আমাদের এক স্যার বলেন- পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো কোনো পুজো না করে 

  ধনীদেশ । আর এদেশ তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর পুজো করেও দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে ।

সূধাময়ী- অত জানি না বাবা । আমি যেটা বলছি শোন- পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন 

  খাই-খাই করিস না । উপোস থেকে ঠাকুরকে খাইয়ে তবে নিজেদের খেতে হয় ।

প্রণব- সে না হয় হবে, কিন্তু আমাদের পুজোটা তাড়াতাড়ি করে দেবে তো ?

সূধাময়ী- ওসব ভাবতে হবে না । ভটচার্যমশায়কে আগে থেকে সব বলে রাখা আছে ।

প্রণব- তাহলে ঠিক আছে । থাকা যাবে ।

সূধাময়ী- (প্রণবের মাথায় হাত বুলিয়ে) আমার সোনা-মানিক । ঠাকুরের পায়ে নিজেকে সঁপে 

     লক্ষ্মীসোনা হয়ে থেকো । ঠাকুর-দেবতা সবার উপরে । ওদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকলে   

    আশীর্বাদ মেলে । দেখি তোর দিদি কোথায় গেল । সকাল সকাল দুটো ফুল-দুর্বো তুলে  

    রাখুক । হঠাৎ কখন ঠাকুরমশায় এসে পড়বে, কে জানে ! (চলে যায়)

প্রণব- (আবার বই পড়তে থাকে) প্রকৃতির অকৃপণ দানে মানব সভ্যতা ও জীব-জগৎ টিকে 

    আছে । তবু আমরা সেই প্রকৃতিকে যথেচ্ছাচার ব্যবহারে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে  

    দিচ্ছি । (হঠাৎ) তবে যে মা বললো- (ডাকে) মা । ও মা ।

ভাড়ার পুরুত- ২

সূধাময়ী- (বাইরে থেকে) আবার কী হলো ? ডাকছিস কেন ?

প্রণব- তুমি বললে ঠাকুর সবার বড় । আর বইতে লেখা- প্রকৃতি শক্তি সব চেয়ে বড় !

(বিরক্ত হয়ে আবার সূধাময়ী আসে)

সূধাময়ী- চুপ করতো ! ঠাকুর-দেবতার উপরে কথা ! বই পড়ছিস- বই পড় ।

প্রণব- বইয়ের কথা মানছো না, আবার জ্ঞানের জন্য সেই বই পড়ে ইস্কুলে পাঠাচ্ছো ! কেন ?

সূধাময়ী- তর্ক না করে শোন, পড়াশুনো করতে গেলে ঠাকুরের আশীর্বাদ লাগে । এমন কি 

  যারা ভিক্ষা করে খায়, ঠাকুরের করুণা না পেলে ভিক্ষে পায় না । বুঝেছিস ?

প্রণব- (বিষন্ন মনে) ঠিক যেন দু নৌকোয় পা দেওয়া ! এসব কিচ্ছু বুঝতে পারি না ।

সূধাময়ী- তোর বুঝতে হবে না ! হতচ্ছাড়া বাঁদর ছেলে কোথাকার ! আজ একটা শুভদিনেও 

    তোদের পিছনে চেল্লাতে হবে ?

প্রণব- কোন পথ ধরবো বলতে পারছো না, শুধু শুধু রাগ করো ! দূর, কিচ্ছু ভাল্লাগে না !

সূধাময়ী- (রেগে) চুপ ! পুজোর দিন ঝামেলা না করে যা বলি শোন- রোজ পড়তে বসার 

    আগে ঠাকুরের নাম নিবি । তাতে পড়াশুনো ভালো হবে । (চলে যায়)

প্রণব- কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, বুঝতে মাথার ঘিলু ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে ! (ভাবতে 

    থাকে) কে বড় ! ঠাকুর, নাকি প্রকৃতি ! প্রকৃতি, নাকি ঠাকুর ! দূর ! ওসব থাক ! 

  পরে ভাববো । (বই মুড়ে রাখে) পড়তে পড়তে খিদেটা তো তবু ভুলে থাকছিলাম । 

    এখন কি করি ! পেট চোঁ-চোঁ করছে ! (ডাকে) মা । ও মা ।

সূধাময়ী- (বাইরে থেকে) এ তো মহা মুশকিল ! কী হয়েছে বলতো ? শুধু ম্যাঁ-ম্যাঁ !

প্রণব- পুজো কখন হবে ?

সূধাময়ী- আরে বাবা, পূর্ণিমেটা লাগুক ! পুরুতঠাকুর ঠিক সময়ে চলে আসবে ।

প্রণব- (নিজের মনে বলে) এলে ভাল । (বই-খাতা গোছাতে থাকে । আলো নিভে যায়)

 

দুই

 

    (হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ধুতি, গায়ে নামাবলি, টিকিতে জবাফুল গুঁজে, গঙ্গাজল ছিটাতে ছিটাতে  

    গ্রাম্য পথ ধরে হন্তদন্ত হয়ে আসে নিবারণ)

নিবারণ- বাপ রে বাপ ! এতগুলো বাড়ির পুজো, চাট্টিখানি কথা ! শরীরের উপরে যা ধকল 

    চলছে, কতক্ষণ পারা যায় ! মালক্ষী, মাকালীর পুজো এলে মাথায় কত দায়ীত্ব চাপে । 

  নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকে না । (গুড়-গুড় করে মন্ত্রপাঠ করতে করতে এগিয়ে চলে)

সূধাময়ী- (বাইরে থেকে) ঠাকুরমশায়, ও ঠাকুরমশায় ।

নিবারণ- (থমকে) আবার কে ডাকে ! (পিছন ঘুরে) কে ?

 

(সূধাময়ী আসে)

সূধাময়ী- আমি সূধাময়ী । প্রণবের মা ।

নিবারণ- কী বলছো- তাড়াতাড়ি বল । দাঁড়াবার সময় নেই ।

ভাড়ার পুরুত- ৩

সূধাময়ী- আপনি যে বললেন- আমাদের পুজোটা সকাল সকাল করে দেবেন । তা কই ?

নিবারণ- দূর বাবা ! সময় পেলে তো ! সবাই যদি টানাটানি করে তো কোন দিকে যাবো ?

সূধাময়ী- (অনুনয়ে) ছেলেমেয়েরা ছটফট করছে ! পুজো না হলে খেতে দিতে পারছি না !

নিবারণ- এ সমস্যা শুধু তোমার একার নয় । সব বাড়ির একই অবস্থা । কাকে ছেড়ে কাকে 

    ধরবো বলতে পারো ?

সূধাময়ী- না ঠাকুরমশায়, ও কথা বলবেন না । অন্যান্য বাড়ির একজন উপোস থেকে বাকি 

    সবাই খেয়ে নেয় । আর আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করতে সবাই উপোস থাকি । 

নিবারণ- খুব ভাল কথা । ঠাকুরের প্রতি ভক্তি থাকলে সংসারে মঙ্গল হবে ।

সূধাময়ী- চেষ্টা তো করছি । কিন্তু বাচ্চারা না খেয়ে কতক্ষণ থাকবে ! খিদেয় কাহিল হচ্ছে ।

নিবারণ- কাহিল হলেও সহ্য করতে হবে । মালক্ষ্মীর আশীর্বাদ পাওয়া মামুলি কথা নয় ।

সূধাময়ী- আমরা না হয় সেটা বুঝলাম, কিন্তু বাচ্চারা-

নিবারণ- শোনো । এখন ঐ মোড়লবাড়ি না গেলে নয় ।(চিন্তা করে) তুমি যাও । এই কটা 

    ঘর সেরে তোমার বাড়ি যাব । আর সময় নষ্ট করতে পারছি না ।(চলে যেতে থাকে)

সূধাময়ী- একটু মনে রাখবেন । না হলে মুশকিলে পড়ে যাব ।

নিবারণ- (ঘুরে দাঁড়িয়ে) আরে বাবা বলছি তো- যাব ! তুমি যাও । চেষ্টা করছি- কিভাবে 

    তোমার পুজোটা তাড়াতাড়ি সারা যায় । (চলে যায়)

সূধাময়ী- অনেকক্ষণ সন্ধ্যে হয়ে গেছে । বাচ্চারা কি করছে- কে জানে !(আলো নিভে আসে)

 

তিন

(বাড়ির উঠানে প্রণব উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছে)

প্রণব- মা সেই যে গেল, এখনো ফেরার নাম নেই । তাহলে কি পুরুতকে পায় নি ! এদিকে 

খিদেয় আমার পেট জ্বলছে । পুজো না হলে তো খেতে দেবে না । কী যে করি ! (চিন্তা   

করে) খই মুড়কি, ফল মূল- সবই জোগাড় করে ঠাকুর ঘরে রেখে গেছে । ওখান থেকে  

যদি একটু একটু করে খাই, তাহলে কি মা বুঝতে পারবে ! মনে হয়- না । যাই । 

(ভিতরে চলে যায়)

(একটু পরে সূধাময়ী আসে)

সূধাসয়ী- কই রে ? তোরা কোথায় ? কী ব্যাপার ! কাউকে দেখছি না ! (সামনে তাকিয়ে) 

 একি ! ঠাকুর ঘরের দরজা খোলা ! (ডাকে) প্রণব । (সামনে এগিয়ে যায়) কী রে ? 

 তুই ওখানে কী করছিস ?

(প্রণব আসে । মুখে খই মুড়কি লাগা)

প্রণব- বিড়াল ঢুকেছিল । তাই-

সূধাময়ী- বিড়াল ঢুকেছিল ! তোর মুখে খই মুড়কি লেগে আছে কেন ?

প্রণব- কই ! না তো । (মুখ মুছে হাতে খই দেখে) দেখছি এ তো খই !

সূধাময়ী- পুজোর জন্যে রেখেছি, তুই তার থেকে তুলে খেলি ?

 

ভাড়ার পুরুত- ৪

প্রণব- খাই নি তো ! হেই হেই করে তাড়া করতে বিড়াল লাফ মেরে পালায় । তখন খইতে 

 ওর পায়ের ধাক্কা লাগে । মনে হয় ঐ খই ছিটকে এসে-

সূধাময়ী- কী সর্বনাশ ! এখনো পুজো হয় নি ! আর এদিকে- (আশঙ্কা নিয়ে ভিতরে যায়)

প্রণব- (নিজের মনে) মা বুঝতে পারলো ! কে জানে ! (আবার মুখ মুছে নেয়)

(চিন্তান্বিত মুখে আবার সূধাময়ী আসে)

সূধাময়ী- বিড়ালে মুখ দিলো কিনা বুঝতে পারলাম না !

প্রণব- পারে নি । আমি তো সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলাম ।

সূধাময়ী- তোর দিদি কোথায় ?

প্রণব- ঐ তো, ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে । ও বলছিল- খুব খিদে পেয়েছে ।

সূধাময়ী- একটা দিন একটু কষ্ট করে থাক বাবা ।

প্রণব- পুরুত আসবে কখন ?

সূধাময়ী- বললো তো- তাড়াতাড়ি আসবে । অনেকক্ষণ হয়ে গেল, তবু-

প্রণব- ওদের আশা ছেড়ে তুমি নিজে পুজো করতো ।

সূধাময়ী- পুরোহিত ছাড়া পুজো- তা কখনো হয় রে বাবা ! আরও একটু সময় অপেক্ষা করে 

    দেখি । এর মধ্যে নিশ্চয় আসবে ।

প্রণব- আর কত অপেক্ষা করবে ! খিদেয় পেটে জ্বালা ধরছে !

সূধাময়ী- ওরে বাবা, বছরে মাত্র একটা দিন ! ঠাকুরের কৃপা পেতে গেলে কষ্ট করতে হয় ।

প্রণব- তুমি কষ্ট করতে বলছো, আর আমি বইতে পড়েছি, স্বামী বিবেকানন্দ বলেছে- খালি 

 পেটে পূণ্য হয় না ।

সূধাময়ী- চুপ করতো ! শুধু পাকামি ! ছোটো ছোটোর মত থেকে মায়ের কথা শুনে চল ।

প্রণব- আমি কি তোমার কথা শুনবো না বলেছি ? বড্ড খিদে লেগেছে, তাই-

সূধাময়ী- সে তো বুঝতে পারছি, কিন্তু কী করবো ! অনেক আগেই পুরুতকে বলে রেখেছি । 

আজ সন্ধ্যায় আবার বললাম । তবু যদি না- (একটু চিন্তা করে) চেষ্টা নিশ্চয় করছে ।  

হয়তো সুযোগ করে উঠতে পারছে না ।

প্রণব- (নিরাশ হয়ে) কবে আর সুযোগ হবে ! তুমি শেষ বারের মত একবার ফোনে কথা 

 বলো । পুরুতের নম্বর ক্যালেণ্ডারের গায়ে লেখা আছে । দাঁড়াও, ঘর থেকে এনে দিচ্ছি । 

 (দ্রুত চলে যায়)

সূধাময়ী- সেই ভাল । নিয়ে আয় তো ! 

(মোবাইল নিয়ে প্রণব আবার আসে)

প্রণব- এই নাও । বাজছে । কানে ধর । (মোবাইল দিতে সূধাময়ী কানে ধরে)

(মঞ্চের মধ্যে একটু উপরে আরও একটা ছোটো মঞ্চ । ওখানে এক টুকরো আলো জ্বলে  

উঠতে দেখা যায়- নিবারণকে)

নিবারণ- আবার ফোন ! মহা জ্বালাতন ! কেন যে যন্তরটা সঙ্গে আনলাম ! (পকেট থেকে 

 ফোন বের করে কানে ধরে) হ্যালো । কে ?

ভাড়ার পুরুত- ৫

সূধাময়ী- আমি প্রণবের মা বলছি ।

নিবারণ- (বিরক্ত হয়ে) আঃ ! আমি তো চেষ্টা করছি ! শুধু শুধু ফোন করে সময় নষ্ট !

সূধাময়ী- কী করবো বাবা ! ছেলেমেয়েদের আর রাখতে পারছি না ।

নিবারণ- সব বাড়ির একই অবস্থা হলে কী করবো ? শুধু ছেলেমেয়ের কথা ! আমি তো আর 

 মাদূর্গা নই যে দশহাত দিয়ে কাজ সারবো ! যত্তোসব-

সূধাময়ী- ঠিক আছে, কী আর করবো ! ইচ্ছা ছিল- এ বছর ভাল ধূতি-শাড়ি দিয়ে পুরুত 

 বিদায় করবো । আশাটা আর পূরণ করতে পারবো না । নিজেকেই পুজো সারতে হবে ।

নিবারণ- (রেগে) হ্যাঁ তাই কর । (হঠাৎ পরিবর্তণ) এই ! কী বললে ? (মনে মনে)ধূতি-

 শাড়ি ! (মোবাইলটা ডান কান থেকে বাঁ কানে এনে) দাঁড়াও-দাঁড়াও !(মোলায়েম স্বরে) 

 পরিস্থিতি দেখতে তো পারছো ! ভুল বুঝো না মা । তোমার জন্য তো চেষ্টা করছি । 

সূধাময়ী- ব্রাহ্মণ-পুরুতদের আমি ভুল বুঝি না বাবা । শুধু ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে-

নিবারণ- ঠিক আছে-ঠিক আছে । বুঝতে পেরেছি । আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না ?

সূধাময়ী- যেটা ভাল হয়- তাই করুন । আমার আশা- পুরুতের মুখে মন্ত্র উচ্চারণ করানো ।

নিবারণ- জানি তো, তুমি ভক্তিমতী লক্ষ্মীমেয়ে । তোমার জন্য আমাকে বিশেষ ভাবে ভাবতে 

 হয় । (ভেবে) ভাবছি- তোমার বাড়িতে যদি একটা ভাড়ার পুরুত পাঠাই-

সূধাময়ী- সেকি ! ভাড়ার পুরুত !

নিবারণ- অসুবিধা কোথায় ? ব্রাহ্মণ দিয়ে পুজোটা তো করাতে পারবে !

সূধাময়ী- (নিমরাজি হয়ে) ঠিক আছে । তাহলে ঐ ধূতি শাড়ি গুলো-

নিবারণ- আহা ! ওগুলো এখন বের করো না । চাল কলা কিছু দক্ষিণা দিয়ে পুরুত বিদেয় 

 করে দিলে চলবে । পরে আমি তোমার বাড়ি গিয়ে ওসব নিয়ে নেব ।

সূধাময়ী- এটা কী ঠিক হবে ! একজন কষ্ট করে পুজো করবে, আর-

নিবারণ- ভুলে যাচ্ছো কেন- ওটা ভাড়ার পুরুত । আমি তো তোমাদের আসল কুলপুরুত ! 

 দায়-বেদায়ে, বিপদ-আপদে তোমাদের পুজো-আচ্চায় আমি তো থাকি ! আমাকে ছেড়ে ঐ 

 ভাড়ার পুরুতকে খুশি করলে পূণ্য হবে ?

সূধাময়ী- ঠিক আছে । আপনি যা বলবেন তাই হবে ।

নিবারণ- (একগাল হেসে) এই তো লক্ষ্মীমেয়ের মত কথা । তাহলে এখন ফোন রেখে দিচ্ছি 

 মা । বড্ড ব্যস্ত আছি । ভাল থেকো । (সারা মঞ্চের আলো নিভে যায়)

 

চার

(সুবোধের বাড়ির সদর দরজা । নিবারণ এসে ডাকতে থাকে)

নিবারণ- সুবোধ । আরে ও ভাই সুবোধ ।

(সুবোধ আসে)

সুবোধ- একি ! জামাইবাবু ! আজ লক্ষ্মীপুজো ছেড়ে এই রাতের বেলায় কি মনে করে ?

নিবারণ- কী করি বল ? দরকার না পড়লে তুই যাস না, আমিও আসি না ।

ভাড়ার পুরুত- ৬

সুবোধ- বাবা ত্যজ্যপুত্র করার পর এখানে বাসা বেধেছি । কিন্তু তোমরা কেউ এলেই না ।

নিবারণ- (সুবোধের গায়ে হাত বুলিয়ে) সুবোধ বড় ভাল ছেলে, শুধু দুধ ছেড়ে মদ গেলে ।

সুবোধ- হে হে হে । কী যে বলো না ! আমি যা কাজ করি, তাতে ওসব একটি-আধটু না 

  হলে চলে না । যাক , ওসব ছাড়ো । চল, ঘরে চল ।

নিবারণ- ঘরে যাওয়ার সময় নেই, বড় সমস্যায় পড়ে এসেছি । তুই একটু সাহায্য করবি ?

সুবোধ- (অবাক হয়ে) সাহায্য ! কেন, কী হয়েছে ?

নিবারণ- কী আর বলি । তুই তো জানিস- ঘরোয়া পুজোগুলো এলে কেমন চাপে পড়ে যাই । 

  তাই বলছি ভাই, তুই যদি একটু সাহায্য করিস তো-

সুবোধ- (আকাশ থেকে পড়ে) আমি ! আমি কী সাহায্য করবো ?

নিবারণ- কয়েকটা জায়গায় যদি যজমানিটা সেরে দিস তাহলে খুব ভাল হয় ।

সুবোধ- য়্যাঁ ! আমি সারবো যজমানি ! বলো কী ?

নিবারণ- আবাক হচ্ছিস কেন ? তুই কী বামুনের বেটা নয় ? নাকি মন্ত্র-তন্ত্র সব গুলে খেয়ে 

  বসে আছিস ?

সুবোধ- কী বলি ! বাবা খুব চেষ্টা করেছিল- মন্ত্রগুলো শেখানোর । আসলে আমি তো তেমন 

  লেখাপড়া শিখি নি । তাই সংস্কৃত শ্লোক মুখস্ত করতে পারছিলাম না । সেই রাগে বাবা 

তাড়িয়ে দিয়েছে ।

নিবারণ- দেবে তো । ব্রাহ্মণ কুলে জন্মে কুলাঙ্গার হয়ে থাকলে কার সহ্য হয় !

সুবোধ- তবে খুচ-খাচ কিছু মন্ত্র-

নিবারণ- ব্যস-ব্যস । ওতেই হবে ।

সুবোধ- কি করে হবে ! বউ-বাচ্চা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে নদীর ধারে পড়ে আছি । মাছ 

  ধরছি আর খাচ্ছি । যেটুকু সংস্কৃত শিখেছিলাম, সে কবেই-

নিবারণ- থাম তো ! যা হিড়িক পড়েছে, ঐ সংস্কৃতের ভুল কেউ ধরবে না । 

সুবোধ- জামাইবাবু, অত ভাবছো কেন ? বাইরের একটা পুরুত ভাড়া করলেই তো হয় ।

নিবারণ- আকালের সময় কোথায় পুরুত ভাড়া পাবো, সবাই ব্যস্ত । শ্বশুরমশাই এ সময় বেঁচে 

  থাকলে কত উপকার পেতাম । এখন তুই ছাড়া আমার ভরসা নেই রে ভাই ।

সুবোধ- (ইতস্তত করে) কিন্তু জামাইবাবু, আমি তো একটা কাজে বের হচ্ছি ! আমার জন্য 

  কয়েকজন অপেক্ষা করে বসে আছে ।

নিবারণ- (অবাক হয়ে) কাজ ! রাতের বেলায় কিসের কাজ ? চুরি করতে যাবি নাকি ?

সুবোধ- হে হে হে । কী যে বলো ! আমরা নদীতে জাল পেতে রেখে এসেছি । এখন ভাঁটা । 

  জোয়ার আসার আগে মাছগুলো কুড়িয়ে নিতে হবে ।

নিবারণ- ছ্যাঃ ! ব্রাহ্মণের ছেলে হয়ে জেলে-বাগ্দির কাজ করছিস ! 

সুবোধ- কী করবো ? পেটের খিদের কাছে ব্রাহ্মণ-বাগ্দি সব এক ।

নিবারণ- চোপ কুলাঙ্গার ! অজাত-কুজাতের কাজের কথা আমার সামনে উচ্চারণ করবি না । 

  ব্রাহ্মণ বংশের একটা মান-সম্মান আছে । এই জন্যে শ্বশুরমশাই ত্যজ্যপুত্র করেছে ।

 

ভাড়ার পুরুত- ৭

সুবোধ- আমার এ কাজের কথা তুমি আগে শোনো নি নাকি ?

নিবারণ- ওসব কথা রাখ । এখন যেটা বলছি শোন । গলায় পৈতে আছে তো ? নাকি ফেলে 

  দিয়েছিস ? (সুবোধের গায়ের গেঞ্জিটা তুলে) হ্যাঁ, আছে । আর দেরি নয়, চল ।

সুবোধ- কোথায় যাব ? সবাই জানে- আমি মাছ ধরে খাই ।

নিবারণ- ও কথা চেপে যা । এমন জায়গায় পাঠাবো, সেখানে কেউ তোকে চেনে না ।

সুবোধ- সেটা আবার কোথায় ?

নিবারণ- আমাদের গ্রামের পশ্চিমে ঐ নীলমাধবপুরে ।

সুবোধ- অতদূরে ! আচ্ছা, সে না হয় হলো, কিন্তু আমার তো নামাবলি নেই !

নিবারণ- হতচ্ছাড়া ! সব খেয়ে বসে আছিস ! চল । সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি । (সুবোধের 

  হাত ধরে টানে)

সুবোধ- দাঁড়াও, বাড়িতে বলে-কয়ে আসি । ওরা সবাই আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে ।

নিবারণ- দাঁড়াবার সময় নেই । চল । কারোর জন্যে কোনো কাজ থমকে থাকে না । ওরা 

  ঠিক চালিয়ে নেবে । আর হ্যাঁ, ওখানে ঢের চাল-কলা, টাকা-পয়সা পাবি, আমি ভাড়ায় 

পাঠাচ্ছি বলে আমাকে কিছু দিতে হবে- তা নয় । সব তুই নিবি । হাজার হোক তুই  

তো আমার নিজের শালা ।

সুবোধ- হে হে হে । চলো ।

নিবারণ- সব সময় হে হে করবি না তো ! ওতে যজমানদের কাছে খেলো হয়ে যেতে হয় । 

  মনে রাখিস- এখন তুই পুরোহিত । সবাই যেমন তোর সম্মান করবে, তেমন তুই দাপট 

দেখাতে পারবি । আয় ।

সুবোধ- (যেতে যেতে ফিরে) এ বউ । আমি জামাইবাবুর সঙ্গে যাচ্ছি । ওরা কেউ খুঁজে এলে 

  ম্যানেজ করে নিস । চিন্তা করিস না, যত দেরি হোক রাতের মধ্যে ফিরে আসবো । 

(মঞ্চের আলো নিভে যায়)

 

পাঁচ

 

  (সূধাময়ীর বারান্দায একটা জলচৌকি । ওর উপরে আসন পাতা । পাশে জলভরা ঘটি 

  থালা দিয়ে ঢাকা)

প্রণব- (বাইরে থেকে) মা । পুরুত এখনো এল না । আর কত দেরি করবে ?

(কথা বলতে বলতে সূধাময়ী আসে)

সূধাময়ী- কী আর বলি ! নিবারণ ভটচার্য নিজেই বললো, তাড়াতাড়ি কাউকে পাঠিয়ে দেবে । 

  কিন্তু কোথায় কে ! কেউ তো এল না !

(প্রণব আসে)

প্রণব- আর আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না বলছি । আমাকে খেতে দাও !

সূধাময়ী- তোদের কষ্ট হচ্ছে- তা বুঝতে পারছি । আমারও হচ্ছে, কিন্তু কী করবো বল ? 

  আর একটু না হয় সহ্য করে দেখ, তারপর- 

ভাড়ার পুরুত- ৮

প্রণব- শুধু সহ্য কর, সহ্য কর ! আর কত সহ্য করবো ? আমি তো তোমার ছেলে ! ঠাকুর 

  পুজোর জন্য নিজের ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছো ? 

সূধাময়ী- উঃ ! কী সমস্যায় পড়েছি ! চুপ কর বাবা, মাকে এমন উভয় সঙ্কটে ফেলিস না । 

  ও রকম ভাবে বলতে নেই !

প্রণব- কী করবো ! ওদিকে সারা পাড়ার পুজো হয়ে গেল, শুধু আমাদেরটা বাকি ! এমন 

  পুরুত ধরে রেখেছো কেন ?

সূধাময়ী- কেন রেখেছি- তুই বাচ্চা মানুষ, বুঝতে পারবি ? আমাদের ভটচার্য একটু উঁচুদরের 

  পুরুত । ভাল শাস্ত্রীয় জ্ঞান আছে ।

প্রণব- হুঁ ! শাস্ত্র ! পেটের জ্বালা ধরলে-

সুবোধ- (বাইরে থেকে) বাড়িতে কেউ আছো ?

সূধাময়ী- ঐ মনে হয় এসেছে । (বাইরের উদ্দেশ্যে) আছি । কে ?

সুবোধ- আমি পুরুত । (মত্তাবস্থায় ভিতরে আসে । মাথার চুল উস্কো-খুস্কো, চোখ লাল । 

  গায়ে জড়ানো নামাবলি) লক্ষ্মীপুজো করবো ।

সূধাময়ী- (অবাক হয়ে) ভটচার্যমশায় আপনাকে কী-

সুবোধ- হ্যাঁ । ঠিক ধরেছ । আমার জামাইবাবু নিবারণ ভটচার্য পাঠিয়েছে ।

প্রণব- (নাক সিটকে) মা । পুজো করবে এই পুরুতে ? (নাকে হাত চাপা দেয়)

সুবোধ- (হাল্কা ক্রোধে) কেন ? আমি কি জেলে-বাগ্দি ? গায়ে নামাবলি, গলায় পৈতে- এসব 

  দেখে কী পুরুত বলে মনে হয় না ?

সূধাময়ী- (ত্রস্ত হয়ে) আসুন-আসুন । ও বাচ্চা মানুষ । ওর কথায় কিছু মনে করবেন না । 

  (প্রণবের পিঠে হাত দিয়ে) যা, ঘরে গিয়ে বস । পুজো হয়ে গেলে ডাকবো । যা । 

(ঠেলে ভিতরে পাঠায়)

সুবোধ- এ কি তোমার ছেলে ?

সূধাময়ী- হ্যাঁ বাবা ।

সুবোধ- ছেলেকে ঠিক মত শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পার নি । ব্রাহ্মণ-পুরুতদের প্রতি এমন 

  আচরণ হলে তো-

সূধাময়ী- (প্রসঙ্গ পাল্টাবার চেষ্টা করে) আপনি আসুন । এই জলচৌকিতে বসুন ।

সুবোধ- (চৌকিতে বসে) যেখানে পুরুতদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকে না, সেখানে আমার মন 

  কিছুতেই বসতে চায় না ।

সূধাময়ী- (থালা ঘটি এনে সুবোধের পা ধোয়াতে বসে) নিন বাবা, থালাতে পা দুটো রাখুন । 

  (সুবোধ থালায় পা রাখে) বাচ্চা মানুষ, কিছু মনে করবেন না বাবা ।

সুবোধ- হুঁ । মায়ের পূণ্যে ছেলের পূণ্য । অনেক কিছু করতে মন চাইছিল । কিন্তু তোমার 

  ভক্তিভাব দেখে সব রাগ চেপে দিলাম ।

সূধাময়ী- পা দুটো উঁচু করুন । (সুবোধ পা উঁচু করলে মাথার নোটন খুলে সেই চুল দিয়ে 

  পা মুছিয়ে দেয়) 

ভাড়ার পুরুত- ৯

সুবোধ- (সূধাময়ীর মাথায় হাত দিয়ে) তোমার কল্যাণ হোক । নাও মা, এবার থালার জলটা 

  খেয়ে নাও ।

সূধাময়ী- ও কথা কী আর বলতে হয় বাবা ? এসব শিক্ষা আমাদের ছোটোবেলা থেকে আছে । 

  (জলের থালাটা নিজের মুখের দিকে নিয়ে যায় । সহসা আবার প্রণব দৌড়ে এসে ধাক্কা 

দিয়ে জলের থালা ফেলে দেয়)

প্রণব- (চিৎকার করে) মা ! একি করছো ?

সূধামসী- (রেগে) তুই একি করলি ?

প্রণব- ঠিক করেছি । ঐ নোংরা মাখা পা ধোয়া জল তুমি খাবে ?

সুবোধ- (কিছুটা নেশার ঘোর কেটে) কী ! ব্রাহ্মণ-পুরুতের পা ধোয়া জলকে নোংরা বলে ! 

  এই জল খেয়ে ছোটোজাতেরা ধন্য হয়ে যায়, আর এই পুঁচকে ছোঁড়া-

প্রণব- (সূধাময়ীকে) ভাল করে লক্ষ্য করেছো- ঐ ফাটা পায়ের মধ্যে কত নোংরা ধুলো জমে 

  আছে ? আর তুমি সেই জল খেয়ে কলেরা ডেকে আনবে নাকি ?

সূধাময়ী- (কাঁদতে কাঁদতে) চুপ কর বাবা । ওসব কথা বলতে নেই । 

প্রণব- আমি কোনো কথা শুনবো না । তুমি এই মুহূর্তে একে বিদায় করবে কিনা তাই বলো ।

সুবোধ- (প্রচণ্ড রেগে)কী ! ছোটোলোকদের মুখে এত বড় বড় কথা ! বাড়িতে ব্রাহ্মণ ডেকে 

  এনে অপমান করা ! (রাগে কাঁপতে কাঁপতে) অভিশাপ দেব, আমি অভিশাপ দেব !

সূধাময়ী- (দৌড়ে সুবোধের পা জড়িয়ে ধরে) না ! না বাবা, অভিশাপ দিও না !

সুবোধ- এই অকাল কুষ্মাণ্ডের জন্য তোর বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে ।

সূধাময়ী- (চিৎকার করে কেঁদে) না ! ফিরিয়ে নাও, ফিরিয়ে নাও বাবা তোমার অভিশাপ ! 

  দোহাই বাবা, আমার বংশটাকে বাঁচাও ! (কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়ে)

প্রণব- মা ! (চিৎকার করে দৌড়ে এসে মাকে ধরে তুলতে থাকে । ওদিকে সুবোধ রাগে ঠক 

  ঠক করে কাঁপতে থাকে । ধীরে ধীরে পর্দা নেমে আসে)

 

 

ঘোষক- যুগ যুগ ধরে এমন অহংকারি অভিশাপ ভূরি ভূরি বর্ষিত হয় সহজ সরল মানুষদের 

  মাথায় । তাতে কতটা অমঙ্গল হয়, তা একটু সচেতনার চোখে দেখলে বোঝা যায় । 

আজকের নাটকের বাচ্চা প্রণব পরবর্তী জীবনে নিজ দক্ষতার জোরে আশানুরুপ শ্রীবৃদ্ধি  

ঘটিয়েছে সংসারে । আর ঐ অভিশাপদাতা মাতাল সুবোধ লাগামছাড়া জীবনযাত্রায় ধীরে 

ধারে নষ্ট করে ফেলেছে নিজেকে এবং নিজের সংসারকে । এই প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্তে চোখ থেকে 

ধোঁয়াশার চাদর সরবে না ? খুলবে না কী জ্ঞান চক্ষু ? ধন্যবাদ ।

 

-শেষ-

নলিনী রঞ্জন মণ্ডল । শ্যামনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা । মোবাইল নং-৯০৮৮১৭৯৩০৪