click on images to know more about the Images

কৈলাস থেকে কলকাতা। (তৃতীয় পর্ব )

Author: নলিনী রঞ্জন মন্ডল

(পূর্ব প্রকাশিতর পর )

-ঃ তিন ঃ-

(সকালবেলা মানদা উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে । এমন সময় কেষ্ট আসে )

 

কেষ্টঃ- ঠাকমা, ও ঠাকমা। গোবরা কাকা কি ফিরেছে ? 

 

মানদাঃ- না রে ভাই। 

 

কেষ্টঃ- সেকি ! ওদের ভোর বেলায় আসার কথা, আর এখনো এলো না ? 

 

মানদাঃ- না। কোথাও কিছু হলো কিনা- কে জানে ! 

 

কেষ্টঃ- সাতটার মধ্যে না এলে তো মুশকিল ! কাল থেকে ক্লাবের ছেলেদের না খাইয়ে রেখেছি । 

 

মানদাঃ- সেকি রে ! পুজোর জন্যে এত ভক্তি ভাব তোদের কবে থেকে হলো ? 

 

কেষ্টঃ- ভক্তি টক্তি জানিনা ঠাকমা । আমার কিন্তু কড়া আদেশ- যতক্ষণ না পুজো শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ কাউকে বোতলের চিপি খুলতে দেবো না। 

 

মানদাঃ- মরণ ! বোতল ছাড়া তাদের কথায় নেই 

রে ?  

 

কেষ্টঃ- এসব বর্তমান যুগের স্টেটাস । তোমরা বুঝবে না। 

 

মানদাঃ- এই নেশার জন্যেে। মেয়েটা জামাইকে সহ্য করতে পারে না 

 

কেষ্টঃ- কি করবো ! ক্লাবের সদস্যরা সব বেকার । দেশে চাকরি নেই । দুটো একটা অফিস যা ছিল, তা এক এক করে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বাংলার বাইরে। যেটুকু কারখানা আছে তাতেও তালা পড়ে যাচ্ছে । তাহলে এই পুজো ছাড়া কিভাবে ওরা আনন্দ-স্ফূর্তি করবে বলো ? 

 

মানদাঃ- দূর মুখপোড়া ! যতসব আদিখ্যেতার 

কথা ! 

 

(হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে নেড়া )

 

নেড়াঃ- কেষ্টদা, ও কেষ্টদা । 

 

কেষ্টঃ- এই । কি হয়েছে ? 

 

নেড়াঃ- তাড়াতাড়ি চলো । ওদিকে কেলেঙ্কারি শুরু হয়ে গেছে । 

 

কেষ্টঃ- কেন ? কি কেলেঙ্কারি শুরু হয়েছে ? 

 

নেড়াঃ- তোমার কথায় সারারাত কড়া পাহারা দিয়েও তবু ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না । ঘোতনা, কেলো ক্লাবের পিছনে আবছা অন্ধকারে গিয়ে বোতলের ছিপি খুলে দিয়েছে । 

 

কেষ্টঃ- শুয়োরের বাচ্চাদের এত সাহস ! যাচ্ছি, এমন ক্যালানী দেবো না- বাপের নাম ভুলে যাবে ! ঠাকমা, শুনলে তো সব কথা ? আর থাকতে পারছি না । ওরা এলে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিও । এই চল তো ! (দুজনে দৌড়ে চলে যায়)

 

মানদাঃ- ম্যাগো ! এরাই করবে ঠাকুর পূজো ! হুঁ ! (বাইরে রিক্সার হর্ন ) ওই বোধহয় ওরা এসে গেছে ।

 

 (হন হন করে রমা, শ্বেতা, গণা ঢুকে পড়ে) 

 

রমা শ্বেতা গণাঃ- দিদিমা। আমরা এসে গেছি। 

 

মানদাঃ-(আনন্দে) ও মা ! তোরা এসে গেছিস ? আয় আয় । (সবার গায়ে মাথা হাত বুলায়) তোদের জন্য কত চিন্তা করছি। 

 

(গৌরী আসে )

 

গৌরীঃ- চিন্তা করলে কি করবো মা ! টানা-হেঁচড়া করে বেরিয়েও তবু দেরি হয়ে গেল । তোমাদের কলকাতার রাস্তাঘাটের যা ছিরি ! (মানদাকে প্রণাম করে)

 

মানদাঃ- থাক মা, তোরা এখন দেবদেবী হয়েছিস । হ্যাঁরে, আমার কাতু ভাইকে দেখছি না তো ! 

 

শ্বেতাঃ- দিদিমা। ওকে আর দেখতে পাবে না। ও এখন মুম্বাইয়ের ফিল্মি সুন্দরীদের স্বপ্ন দেখছে। 

 

(লট-বহর নিয়ে গোবরা আর পিছনে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে গান করতে করতে কাতু আসে )

 

কাতুঃ- (সুরে) নায়ক হবো, আমি নায়ক হবো। 

 

মানদাঃ- ও মা ! তাই নাকি ? 

 

গোবরাঃ- তাই নাকি মানে ! তুমি দেখে নিও, তোমার এই নাতি ফিল্মি বাজারে আগুন হয়ে জ্বলবে । সারা দুনিয়া এর প্রেমে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর তুমিও একটার পর একটা টুকটুকে নাত বউ পাবে। 

 

মানদাঃ- (খুশি হয়ে) আয়, আয় দাদুভাই। (কাতুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে) আমার এমন সুপুরুষ নাতি চিরকাল মাকাল ফল হয়ে থাকবে- তা হয় ! যা। গোবরা, এই ঘরটা ওদের খুলে দে । 

 

গোবরাঃ- আয় । তোরা দুই ভাই আমার সঙ্গে আয় । (বাক্স সহ গণা কাতুকে নিয়ে চলে যায়)

 

মানদাঃ- (রমা শ্বেতাকে) যা দিদিভাই। তোরা দু বোন আমার ওই ঘরে বিশ্রাম নে। যা। (রমা চলে যায়)

 

শ্বেতাঃ- (যেতে যেতে ফিরে) দিদিমা । মামা শুধু ভাগ্নেকে নায়ক করার চেষ্টা করছে। আমাকে একটু সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ করে দিতে বলো না । 

 

গৌরীঃ- না ! মেয়েদের জন্য ও লাইন ভালো নয়। 

 

শ্বেতাঃ- মা । তুমি বুঝতে পারছ না । আজকাল ছেলে মেয়ে আলাদা নয়। সব সমান। 

 

গৌরীঃ- সেটা এখানে। আমাদের কৈলাসের মেয়েদের জন্য নয়। 

 

শ্বেতাঃ- (গোঁসা করে) মহিষ কাকা ঠিক বলে- আমাদের দু নম্বরি বংশ। মর্তের মেয়েদের যা হয় হোক, যেন নিজের মেয়ে ঠিক থাকে। 

 

গৌরীঃ- একদম চাপা করবি না । মুখ ভেঙ্গে দেবো। 

 

মানদাঃ- থাম। আমি দেখছি। দেখ দিদিভাই, ওসব লাইন সত্যি ভালো নয়। সিগারেট, বিড়ি, মদ খেতে হবে, ছোট ছোট টাইট প্যান্ট গেঞ্জি পরতে হবে। পারবি ওসব পরতে ? 

 

শ্বেতাঃ- আজকাল ওসবে কেউ কিছু মনে করে না। দেখ নি- এ যুগের প্যান্ডেলে মূর্তিগুলোতে কেমন বিচিত্র পোশাক পরিয়ে পুজো করছে ? 

 

মানদাঃ- এ পোড়ার মুখো দেশের কথা ছাড় । এখন যা হচ্ছে, এগুলো কি পুজো বলে ? 

 

শ্বেতাঃ- তবু তো লোকে ভক্তি করে দেখে । কেউ মুখ ঘুরিয়ে নেয় না। 

 

মানদাঃ- (নাক সিটকে) হুঁ ! ভক্তি না ছাই ! 

 

শ্বেতাঃ- দিদিমা। এটা যুগের পরিবর্তন। সবাইকে মানতে হবে। 

 

গৌরীঃ- পাগলামি করিস না শ্বেতা । সামান্য একটু ভুলের জন্য ভবিষ্যতে কেউ আর তোকে দেবী বলে মানবে না । 

 

শ্বেতাঃ- দরকার নেই । একটা সিরিয়াল করতে পারলে...

 

গৌরীঃ- (রেগে) আবার সেই এক কথা ? 

 

(গোবরা আবার দৌড়ে আসে )

 

গোবরাঃ- কি হয়েছে-কি হয়েছে ? এত চিৎকার করছিস কেন ? 

 

গৌরীঃ- যত গন্ডগোলের মূল তো তুই । 

 

গোবরাঃ- আমি ! আমি আবার কী করলাম ? 

 

গৌরীঃ- তোর ভাগ্নির কথাগুলো বসে বসে শোন । আমার আর ভালো লাগে না (বিরক্ত হয়ে চলে যায়)

 

গোবরাঃ- কি হয়েছে রে শ্বেতা ? একি ! তুই কাঁদছিস কেন ? কি হয়েছে বল না ! (শ্বেতা অভিমানে চলে যায় ) যা ব্বাবা ! এদের কি হয়েছে গো মা ? 

 

মানদাঃ- না-না, তেমন কিছু হয়নি । মামার বাড়ি এলে সবাই এরকম একটু আবদার করে । হ্যাঁ ভালো কথা, জামাইকে দেখতে পাচ্ছি না- জামাই 

কোথায় ? 

 

গোবরাঃ- কি আর বলবো ! (চুপি চুপি) তোমার মেয়ের গোঁয়ার্তুমির জন্যে...

 

মানদাঃ- ঝগড়া টগড়া হয়েছে নাকি ? 

 

গোবরাঃ- কার সঙ্গে হবে ? জামাইবাবু সে মানুষ নয়। শুধু প্রাগার্য আর একটু নেশা করে, তাতেই...

 

মানদাঃ- আজকাল কে না নেশা করে ! বামুন কায়েত পর্যন্ত নেশা করে কি কাণ্ডটাই না করছে ! আমার মেয়েটা ছোটো থেকে ভীষণ একগুঁয়ে। (চিন্তা কর) ওদিকে জামাইটা কৈলাসে একা পড়ে রইলো ! 

 

গোবরাঃ- ভেবো না, সব ব্যবস্থা করে এসেছি । এখন সমস্যা- মহিষ কোথায় ? ও তো আমার পিছনে 

ছিল । এতক্ষণ এসে যাওয়ার কথা ! দাড়াও । একটু দেখে আসি । (চলে যায়) 

 

মানদাঃ- একি গেরো হলো ! মহিষ না হলে গৌরী ত্রিশূল মারবে কার বুকে ! লোকে খুঁত ধরবে তো

! আজকাল কত ঢং এর পূজো হচ্ছে, তাহলে লোকে কি ভাববে- এটাও একটা ঢং ! 

 

(আলো নিভে যায়)

 

 

(ক্রমশঃ প্রকাশ্য )