click on images to know more about the Images

জয় ভীম (মঞ্চ নাটিকা)

Author: নলিনী রঞ্জন মন্ডল

-: চরিত্র:-``` ``` 

ভীমরাওঃ- দলিত ছাত্র। সোমনাথ, বাসুদেব ও আরো কয়েকজনঃ- বর্ণবাদী ছাত্র। শিক্ষক, যুবক, ভীমরাও এবং বুদ্ধদেব।

 ```-এক-

(গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোমনাথ আসে)

সোমনাথঃ- প্রাথমিক গণ্ডিটা তো পার হলাম। এবার যেতে হবে হাইস্কুলে। যাওয়ার আগে দিন- কয়েক ঘুরে নিই। (সামনে তাকিয়ে) ঐ একটা ছেলে যাচ্ছে। ওকে ডাকি। (ডাকে) এই। এই ছেলেটা। কী রে, ভয় পাচ্ছিস? তুই তো আমার বয়সি। আয় না, দুজনে একটু গল্প করি। (ভীমরাও আসে। হাতে একটা ছড়ি) তোদের বাড়ি কোথায়?

 

ভীমরাওঃ- আমাদের বাড়ি এই পাড়ায়।

 

সোমনাথঃ- এই পাড়ায়? তা তোর নাম কী?

 

ভীমরাওঃ- আমার নাম ভীমরাও আম্বেদকর।

 

সোমনাথঃ- অ। কই, আমাকে তো জিজ্ঞেস করলি না- আমাদের বাড়ি কোথায়?

 

ভীমরাওঃ- বলো, তোমাদের বাড়ি কোথায়?

 

সোমনাথঃ- ঐ যে পাড়াটা দেখা যাচ্ছে, ওখানে। তোর হাতে ছড়ি কেনো?

 

ভীমরাওঃ- মাঠে আমাদের ছাগল চরছে, আনতে যাচ্ছি। (চলে যেতে উদ্যত)  

 

সোমনাথঃ- এক্ষুনি যাবি? দাঁড়া, একটু গল্প করি। (একটু অবাক হয়ে) এতো ছাড়া ছাড়া হয়ে থাকছিস কেনো? কাছাকাছি আয়। (ভীমরাওয়ের দিকে এগোয়) 

 

ভীমরাওঃ- না-না, তুমি আমার কাছে এসো না।

 

সোমনাথঃ- কেনো রে? ভাবছিস আমার ছোঁয়া লেগে তোর জাত যাবে? ভয় নেই, আমি ছোটোজাত নই।

 

ভীমরাওঃ- তুমি না হলেও আমি তো ছোটোজাত। তাই সরে থাকছি। 

 

সোমনাথঃ- (অবাক হয়ে) য়্যাঁ। তুই ছোটোজাত?

 

ভীমরাওঃ- হ্যাঁ। তোমাদের ঐ পাড়ার সবাই তো ভাই বলে। 

 

সোমনাথঃ- তাই তোর এমন ভীরু ভীরু হাবভাব। তুই কোন জাতের রে?

 

ভীমরাওঃ- চামার। 

 

সোমনাথঃ- (ভাবে) চা-মা-র। দেখতে তো মানুষের মতো, তবু চামার হলি কী ভাবে?

 

ভীমরাওঃ- অতো-শতো জানি না। সবাই বলে, তাই বললাম। এবার আমি যাই। 

 

সোমনাথঃ এই, যাস না। আর একটু দাঁড়া। (ভীমরাওয়ের দিকে যায়) 

 

ভীমরাওঃ- কাছে আসছো কেনো? সরে যাও। সূর্য পিছনে চলে গেছে।

 

সোমনাথঃ- মানে? সূর্য পিছনে গেছে তো কী হয়েছে?

 

ভীমরাওঃ- আমার ছায়া তোমার গায়ে লাগবে।

 

সোমনাথঃ- (অবাক)ছায়া গায়ে লাগলে কী হবে? 

 

ভীমরাওঃ- যদি তোমার জাত নষ্ট হয়ে যায়। 

 

সোমনাথঃ- (অবাক হয়ে) তাই? আমি এখনো অতো কিছু জানি না রে।  তোর জানা থাকলে আমাকে একটু বলতো ভীমরাও- জাত কীভাবে যায়, আর গেলে কী হয়? 

 

ভীমরাওঃ- কী ভাবে যায়, আর গেলে কী হয়- আমি অতো কিছু জানি নাকি? তবে এইটা ভালো করে জানি যে, তোমার জাতের লোকেরা জানতে পারলে আমাকে পিটিয়ে মারবে। আমি যাই। (দৌড়ে চলে যায়) 

 

সোমনাথঃ- ভীমরাও। এই ভীমরাও, যাস না। শোন। (এগিয়ে যায়) 

 

(মঞ্চের আলো নিভে আসে) 

 

 ```-দুই-``` 

 

(স্কুলমাঠে বাসুদেব ও কয়েকজন ছাত্র হৈ-হল্লা করছে। এমন সময় শিক্ষক আসে) 

 

শিক্ষকঃ- (হুঙ্কার দিয়ে) এই, চোপ। কিসের এতো হুল্লা? দেখছিস না, অফিসে নতুন ছাত্ররা ভর্তি হচ্ছে। তোরা কি ভর্তি হয়েছিস? 

 

সবাইঃ- হ্যাঁ স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- ভালো কথা, কিন্তু কাউকে যেন গণ্ডগোল করতে না দেখি। (সবাইকে নিরিক্ষণ করে শেষে বাসুদেবকে বলে) শোন, আপাতত তুই মনিটর হয়ে সবাইকে সামলে রাখ। (দূরে তাকিয়ে) এই ছেলেটা। ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিস? এদিকে আয়। 

 

(ধীরে ধীরে ভীমরাও আসে) 

 

ভীমরাওঃ- (দূর থেকে দুহাত জড়ো ও মাথা নত করে) নমস্কার স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- নমস্কার- মানে? 

 

ভীমরাওঃ- আপনাকে প্রণাম জানাচ্ছি স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- প্রণাম জানাচ্ছিস- এই ভাবে? শিক্ষকদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হয়, এটা

প্রাইমারিতে কেউ শেখায় নি? (ভীমরাও নিশ্চুপ) কিরে, চুপ করে আছিস যে? 

 

ভীমরাওঃ (অনুনয়ে) ক্ষমা করুন স্যার, ঐ কাজটা আমাকে করতে বলবেন না। 

 

শিক্ষকঃ- (আশ্চর্য হয়ে) কি বললি? ঐ কাজটা তোকে করতে বলবো না? 

 

ভীমরাওঃ- না স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- কেনো? 

 

ভীমরাওঃ- পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে আমার বাবা-মা বারণ করে দিয়েছে। 

 

শিক্ষকঃ (অত্যাশ্চর্য হয়ে) বারণ করে দিয়েছে। তোর বাবা-মা'র এতো দম্ভ? ছেলেকে স্কুলে

পাঠিয়েছে কিসের জন্য? 

 

ভীমরাওঃ- (অনুনয়ে) স্যার, পড়াশুনো শেখার জন্য। 

 

শিক্ষকঃ- স্যারকে সম্মান না দিয়ে ফোকটে পড়াশুনো শিখবি? এখানে আয়, আগে ভালো করে তোর সহবৎ শিক্ষাটা দিই। আয়। (ভীমরাও নিশ্চুপ) বাসুদেব, ওকে ঘাড় ধরে এনে আমার পায়ের কাছে ফেল তো। 

 

বাসুদেবঃ- এই, চল তো সবাই। (বীরদর্পে কয়েক জনকে নিয়ে গিয়ে ভীমরাওকে ধরে) 

 

ভীমরাওঃ- না। তোমরা আমাকে ধরো না। 

 

বাসুদেবঃ- ধরবো না! স্যারকে অসম্মান। চল। (ভীমরাওয়ের হাত ধরে জোর করে টানতে টানতে এনে শিক্ষকের পায়ের উপর ফেলে দেয়) 

 

শিক্ষকঃ- এইটুকু ছেলে, তার আবার এতো দম্ভ! (ভীমরাওকে কান ধরে টেনে তোলে) ওঠ।

বিদ্যালয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই... 

 

ভীমরাওঃ- (উঠতে উঠতে কান্নার স্বরে) ক্ষমা করুন স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- ক্ষমা করবো! বল, তোর বাবা-মাযের এতো অহঙ্কার কেনো? স্যারের পায়ে হাত দিতে কিসের এতো দ্বিধা ? 

 

ভীমরাওঃ- দ্বিধা নয় স্যার। আমরা ছোটোজাত। যদি আপনার গায়ে ছোঁয়া লাগে, তাই... 

 

শিক্ষকঃ (আকাশ থেকে পড়ার মতো) য়্যাঁ! ছোটোজাত! 

 

ভীমরাওঃ- হ্যাঁ স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- কোন জাত? 

 

ভীমরাওঃ- (আড়ষ্ট স্বরে) আমরা চামার। 

 

সবাইঃ- (চমকে ওঠে) চা-মা-র। 

 

শিক্ষকঃ- কী সর্বনাশ! আগে বলবি তো! 

 

ভীমরাওঃ- আমি তো বলছি স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- চোপ! (ব্যঙ্গে) আমি তো বলছি স্যার! তোর নাম কী? 

 

ভীমরাওঃ- আমার নাম ভীমরাও আম্বেদকর। 

 

শিক্ষকঃ- আ-হা! নামের কী বাহার! কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন! বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার ইচ্ছা! কেনো, চামারের ছেলের এতো লেখাপড়ার শখ কেনো? 

 

ভীমরাওঃ- শুনেছি, লেখাপড়া শিখলে অনেক কিছু জানা যায়, শেখা যায়। তাই... 

 

শিক্ষকঃ অনেক কিছু জেনে, শিখে তোদের কী লাভ? তোরা ছোটোজাত, চামার। শিক্ষিত হয়ে গেলে বাবু হয়ে যাবি। তখন তোদের জাত-ব্যবসা কে করবে? 

 

ভীমরাওঃ জাত-ব্যবসার সঙ্গে পড়াশুনোর কী সম্পর্ক স্যার? লেখাপড়া শিখবো তো বিবেক-

বুদ্ধি-জ্ঞান বাড়ানোর জন্য। 

 

শিক্ষকঃ- বাঃ! বেশ ধান্ধাবাজি মনোভাব। গাছের খাবি, আবার তলারও কুড়াবি। ভালোই মতলব ফেঁদেছিস। জন্ম নিয়েছিস চামারের ঘরে। তাহলে চামারের মতো জীবন যাপন করতে অসুবিধা কোথায়? 

 

ভীমরাওঃ- (জোড় হাতে করুণ স্বরে) নারাজ হবেন না স্যার। আমার বই পড়ার খুব ইচ্ছা। একটু পড়াশুনো শিখতে দিন স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- এতোই যখন ইচ্ছা, তখন অন্য স্কুলে যেতে পারতিস। এখানে আসার কী দরকার?

আমাদের জাত মারবি বলে ? 

 

ভীমরাওঃ- না তা নয়। এটা কাছাকাছির মধ্যে পড়ে, তাই... 

 

শিক্ষকঃ- চোপ! (আক্ষেপ) আমাদের হেডস্যারই বা কেমন মানুষ। একটা চামারের ছেলে... (ভীমরাওকে) এই শোন, হেডস্যার তোকে এ্যালাও করেছে- ব্যস, ঐ পর্যন্ত। তুই যেনো কারোর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি করবি না। এমন কী বেঞ্চেও বসতে পারবি না। ক্লাসে এসে মেঝেতে চট পেতে বসবি। মনে থাকবে ? 

 

ভীমরাওঃ- যা বলবেন সব শুনবো স্যার, দয়া করে শুধু একটু পড়াশুনো করতে দিন। 

 

শিক্ষকঃ- শুনতে তোকে হবেই। না শুনলে রেহাই আছে নাকি! যা, আজ বাড়ি যা। তোকে ছুটি দিলাম। কাল আসবি। (ভীমরাও দূর থেকে আবার নমস্কার করে চলে যায়) 

 

বাসুদেবঃ- স্যার। এবার আমাদের কী হবে ? আপনার কথায় আমরা ওকে ছুঁয়েছি। 

 

শিক্ষকঃ- শুধু তোরা? আমি যে ওর কান ধরে টেনে তুললাম, তার বেলা ? 

 

বাসুদেবঃ- কী করবো স্যার । এ কথা বাবা শুনলে তুলকালাম করে ছাড়বে। 

 

শিক্ষকঃ- যাকগে যাক, কেউ কাউকে বলবি না। এখন তোরা সোজা চলে যা নদীতে। গিয়ে একুশটা ডুব দিয়ে মন্দিরে ঢুকবি। তারপর গায়ে গঙ্গাজল আর তুলসিপাতা ছিটিয়ে তবে বাড়িতে যাবি। তাহলে আর কোনো দোষ থাকবে না। যা।  

 

সবাইঃ- ঠিক আছে স্যার। (চলে যেতে উদ্যত) 

 

শিক্ষকঃ- দাঁড়া। (সবাই দাঁড়ায়) আর একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ, ভীমরাওয়ের সঙ্গে তোরা কেউ বন্ধুত্ব করবি না। যা। (সবাই চলে যায়) আমি এখন কী করি! দেখি, হেড স্যারকে বলে চলে যাই। আমাকেও তো নদীতে নামতে হবে। 

 

(মঞ্চের আলো নিভে যায়) 

 

    ```-তিন-

 

(ক্লাসঘর। বাসুদেব সহ ছাত্ররা যে যার জায়গা দখল নিয়ে হুড়োহুড়ি করে। এমন সময় ভীমরাওকে আসতে দেখে সবাই চুপচাপ হয়ে নাক সিটকে সরে যায়) 

 

বাসুদেবঃ- এই ছোটোজাত। কাল তো আমাদের জাত মারার চেষ্টা করেছিস, আজ যেনো...(হঠাৎ জোরে) এই, এদিকে এগোবি না। বস-বস, ঘরের ঐ কোনে গিয়ে বস। 

 

সবাইঃ- (এক সুরে) ছোটোজাত-ছোটোজাত। 

 

ভীমরাওঃ- (মনে মনে বলে) কী কারণে যে এদের এমন মনের বিকার- বুঝতে পারি না! 

 

বাসুদেবঃ- এই। কিছু বলছিস নাকি রে? 

 

ভীমরাওঃ- কী বলবো। আমার ছোঁয়া লাগলে তোমাদের কী হবে- এই কথাটাই ভাবছি। 

 

বাসুদেব: আমাদের জাত যাবে রে ছোটোলোক। 

 

ভীমরাওঃ- মানুষের ছোঁয়ায় যদি মানুষের জাত যাবে, তাহলে কাল তো তোমাদের ছোঁয়া নিয়ে আমি বাড়ি গেলাম। কই, আমার তো কিছুই হলো না? 

 

বাসুদেবঃ ন্যাকা চৈতন্য। আনিস না- তোরা জন্ম থেকে ছোটোজাত! তোদের আবার জাত যাবে কী ভাবে ? বরং আমাদের ছোঁয়ায় কিছুটা হলেও তোর জীবন ধন্য হয়েছে। 

 

ভীমরাওঃ- কিন্তু আমি তো উল্টো ছবি দেখছি। 

 

বাসুদেবঃ- মানে! তুই তো চামার। তুই আবার কীসের ছবি দেখছিস? 

 

ভীমরাওঃ- আমরা কতো কষ্টের জীবন নিয়ে বেঁচে আছি। তবু আমাদের উপর তোমরা দলন-পীড়ন করে মনে সুখ পাচ্ছো, এতে ধন্য হচ্ছো না ? 

 

বাসুদেবঃ- (রেগে) কী বললি? দাঁড়া। তোকে এক ঘুঁসি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবো। (ঘুঁসি বাগিয়ে এগোয়, ভীমরাও ভয়ে কুঁকড়ে যায়) 

 

(সোমনাথ আসে) 

 

সোমনাথঃ- এই। ওকে মারছিস কেন? 

 

বাসুদেবঃ- আমি মারছি তো তোর কী? দেখছিস না- ও ছোটোজাত? 

 

সোমনাথঃ (অবাক হয়ে) ছোটোজাত! (ভীমরাওকে ভালো করে দেখে) আরে! তুই সেই ভীমরাও না? এখানে কী করছিস? 

 

ভীমরাওঃ- কাল এই ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। 

 

সোমনাথঃ- কাল ভর্তি হয়েছিস? খুব ভালো। আমি অবশ্য আজকের হলাম। 

 

বাসুদেবঃ- ওর সঙ্গে তোর এতো কিসের ভাব? তুইও কি ছোটোজাত? 

 

সোমনাথঃ- আমি কী কারণে ছোটোজাত হবো! আগে থেকে ওকে চিনি, তাই কথা বলছি। এই

ভীমরাও। আয়, আমার কাছে বসবি আয়। 

 

বাসুদেবঃ- মামার বাড়ির আব্দার! একটা ঘুঁসিতে বদন বিগড়ে দেবো। 

 

(শিক্ষক আসে) 

 

শিক্ষকঃ- এই। এতো হল্লা কেনো? এটা মাছবাজার পেয়েছিস? যা. সবাই বস। (সবাই যে যার জায়গায় বসে পড়ে। ভীমরাওয়ের দিকে নজর যেতেই) হ্যাঁ। রোজ এসে তুই ওখানেই বসবি। আর তোর ভাঁড় কই? 

 

ভীমরাওঃ- (কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বলে) ভাঁড়... 

 

শিক্ষকঃ- লেখাপড়া শিখে চাঁদ ধরার শখ হয়েছে যখন, তখন গলায় মাটির একটা ভাঁড় বেঁধে স্কুলে আসবি। তুই অচ্ছুৎ চামার। যেখানে সেখানে খুতু ফেলা তোর নিষিদ্ধ। ফেলতে হলে ঐ ভাঁড়ে ফেলবি। মনে থাকে যেনো। 

 

বাসুদেবঃ- স্যার। (সোমনাথকে দেখিয়ে) এ ছেলেটা নতুন এসেছে। এ বলছে, ভীমরাও নাকি এর বন্ধু। 

 

শিক্ষকঃ- (বিস্ময়ে) য়্যাঁ! বন্ধু! তুইও কি অচ্ছুৎ, ছোটোজাত? 

 

সোমনাথঃ- না স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- তাহলে কীভাবে বন্ধু হলো? 

 

সোমনাথঃ- ক্লাস ফোরের পরীক্ষা শেষ হতে একদিন রাস্তায় বেড়াতে বের হযেছি। তখন ওর

সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই থেকে... 

 

শিক্ষকঃ- খবরদার! দুধের সঙ্গে জল মেশাবার চেষ্টা করবি না। বস। (সবাই বসে পড়ে) সবাই বুক লিস্ট পেয়েছিস ? 

 

সবাইঃ- হ্যাঁ স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- তাড়াতাড়ি কেনাকাটা কর। তা না হলে পঠন-পাঠন শুরু করতে দেরি হয়ে যাবে। আর এখন কারোর বইপত্র নেই যখন, তখন কিছু সাধারণ প্রশ্ন করি। দেখি কে কেমন উত্তর দিতে পারিস। 

 

বাসুদেবঃ- স্যার, একটু জল খেয়ে আসি। 

 

শিক্ষকঃ- প্রশ্ন করতে না করতেই জল পিপাসা লাগলো? যা. তাড়াতাড়ি খেয়ে আয়। (ঘরের অন্য একটা কোনে রাখা কুঁজো থেকে বাসুদেব মগে জল ঢেলে খেয়ে চলে আসে) বল তো দেখি- ধর্মগ্রন্থকে অশুচি করার জন্য ভগবান রামচন্দ্র কোন শুদ্রকে হত্যা করেছিলেন ? (সবাই চুপচাপ) কি রে, কেউ জানিস না? 

 

ভীমরাওঃ- (সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে) আমি বলবো স্যার? 

 

শিক্ষকঃ- (অবাক হয়ে) এরা কেউ পারলো না, তুই ছোটোজাত হয়ে বলতে পারবি ? 

 

ভীমরাওঃ- হ্যাঁ স্যার পারবো। 

 

শিক্ষকঃ- বল দেখি। 

 

ভীমরাওঃ- শুদ্ররাজ শম্বুককে হত্যা করেছিলো। 

 

শিক্ষকঃ- য়্যাঁ! তুই কী রামায়ণের কাহিনী পড়েছিস? 

 

ভীমরাওঃ- পড়িনি স্যার, শুনেছি। 

 

শিক্ষকঃ- শুনেছিস! তাহলে ইতিহাস থেকে একটা প্রশ্ন করি। উত্তর দিতে পারবি? 

 

ভীমরাওঃ- বলুন। চেষ্টা করে দেখি। 

 

শিক্ষকঃ- বল তো- আমাদের দেশের ময়ূর সিংহাসন কে লুট করে নিয়ে গেছে ? 

 

ভীমরাওঃ- পারস্য সাম্রাট নাদির শাহ। 

 

শিক্ষকঃ- (বিস্ময়ে) ওবে বাবা! এ ছেলে বড় হয়ে তো সাংঘাতিক একটা কিছু হতে পারে। সামান্য চারটে ক্লাস পড়ে এতো কিছু জানে! (প্রকাশ্যে অন্য ছাত্রদের) এই, মুচির ছেলে এতো কিছু বলতে পারে, আর তোরা! (হুঙ্কার দিয়ে) বাসুদেব। তোরা কী ঘাস খেয়ে লেখাপড়া শিখিস? একটুও কিচ্ছু জানিস না? 

 

ভীমরাওঃ- স্যার, আমিও একটু ভাল খেয়ে আসবো? বড্ড পিপাসা লেগেছে। 

 

শিক্ষকঃ- ওর খাওয়া দেখে তোর খাওয়া পেলো? কোথায় জল খেতে যাবি? 

 

ভীমরাওঃ- বাইরের ঐ পুকুরে... 

 

শিক্ষকঃ- খবরদার না। তুই ছোটোলোক, জাতে চামার। ঐ জল ছুঁয়ে দিলে পুকুরটা অপবিত্র হয়ে যাবে। তখন আর এক কেলেঙ্কারি হবে পড়বে। (অন্য ছাত্রদের) তোরা কেউ ওর মুখে জল ঢেলে দিতে পারবি? (সবাই মাথা নিচু করে থাকে। সোমনাথকে) তোর নাকি দরদ বেশি, তুই শোন। 

 

সোমনাথঃ- (একটু ভয়ে ভয়ে) বলুন স্যার। 

 

শিক্ষকঃ- একটা কাগজের কাঁপা করে ওর মুখে জল ঢেলে দে তো। 

 

সোমনাথঃ- (বিস্মিত হয়) স্যার আমি ? 

 

শিক্ষকঃ- হ্যাঁ তুই। সাবধানে ঢালবি, যেনো ছোঁয়া না লাগে। 

 

সোমনাথঃ- (ইতস্তুত করে) ঠিক আছে স্যার। (মগে জল এনে কাগজের কাঁপা করে সাবধানে ভীমরাওয়ের মুখে ঢালতে থাকে) 

 

ভীমরাওঃ- (জলপানের পর মঞ্চ অন্ধকার হয়ে একটা ফোকাস এসে মুখে পড়ে) এ আমি কোন নরকে এলাম। এটা কি শিক্ষালয়, নাকি নরকালয়। হায়রে কপাল। (নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিতে দিতে মেঝের দিকে ঝুঁকিয়ে গড়ে) 

 

(ক্রমে ক্রমে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়)

       - চার- 

 

(সম্পূর্ণ অন্ধকার মঞ্চ) 

 

বুদ্ধদেবঃ- (স্নেহাতুর স্বরে) ভী-ম। (প্রতিধ্বনি) 

 

ভীমরাওঃ- (চমকে) কে? (আঁধার মঞ্চ ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়। নত মস্তকে থাকা কৈশোর উত্তীর্ণ ভীমরাও মাথা তোলে। বরাভয় মুদ্রায় এগিয়ে আসে বুদ্ধদেব) কে তুমি প্রভৃ? 

 

বুদ্ধদেরঃ- আমি? আমি তথাগত। গৌতম বুদ্ধ। 

 

ভীমরাওঃ- (চনমনে হয়ে) বুদ্ধদেব। ভগবান আমার সামনে। আমি ভুল দেখছি না তো। 

 

বুদ্ধদেবঃ- বর্তমান বিশ্বের মহাজ্ঞানী, এতো সহজে তোর ভুল হতে পারেনা। ঠিকই দেখছিস। 

 

ভীমরাওঃ- ঠিকই দেখছি। (ভক্তিতে আপ্লুত) আমার প্রণাম নাও প্রভু। (প্রণাম করে) 

 

বুদ্ধদেবঃ- ঠিক আছে। তবে এই নির্জন নিভৃতে তুই একা বসে কী ভাবছিস বাবা? 

 

ভীমরাওঃ- (ক্ষোভে) আমার সমাজের দুরাবস্থা কথা ভাবতে ভাবতে শেষ হয়ে যাচ্ছি প্রভু। 

 

বুদ্ধদেবঃ- শুধু ভেবে কী করবি। তোর সমাজের লোকজনদের পিঠে ঘা মেরে জাগিয়ে তোল- যাতে সবাই মিলে ধর্মীয় অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারিস। তবে সবার আগে তোর নিজেকে শক্ত হতে হবে। 

 

ভীমরাওঃ- শক্ত। (নিরুৎসাহের হাসি) কীভাবে শক্ত হবো প্রভু। শৈশব থেকে দেশ-সমাজ, স্কুল-কলেজে ঘৃণার পর ঘৃণা আর অপমানের আঘাত খেতে খেতে মাটিতে মিশে যাচ্ছি। 

 

বুদ্ধদেবঃ- সব জানি। স্কুলের বেঞ্চে বসতে দেয় নি, দূরে মেঝেতে বসে পড়াশুনো করেছিস। দূর থেকে ছুড়ে দেওয়া জলে তৃষ্ণা মিটিয়েছিস। তবু বলবো সমস্ত অপমান, অত্যাচার সহ্য করেও তোকে শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। 

 

ভীমরাওঃ- চেষ্টা করছি, পারছি কই। ওদের ধর্মীয়-ঝড়ের ধাক্কায় টাল-মাটাল হয়ে পড়ছি। 

 

বুদ্ধদেবঃ- তবু তোকে দাঁড়াতে হবে। তোর সমাজের পঁচাশি ভাগ মানুষ তথাকথিত ধর্মাঘাতে কোমরভাঙা হয়ে তোরই মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে ওদের শিক্ষিত করে তোল। তা না করতে পারলে ওরা দাঁড়াতে শিখবে কী করে? 

 

ভীমরাওঃ- (হতাশ হয়ে) বিদ্যা-বুদ্ধি। বত্রিশটা ডিগ্রী লাভ করেও পাচ্ছি শুধু উৎপীড়ণ আর লাঞ্ছনা। পাচ্ছি না- শিক্ষার কোনো মর্যাদা। 

 

বুদ্ধদেবঃ- ভূভারতে তোর সমান বিদ্যান খুবই বিরল, তাই ওদের এতো গাত্রদাহ। এদেশ যদি শিক্ষার মূল্য দিতো, তাহলে পুস্তক পাঠের জন্য শম্বুকের প্রাণ যেতো না। ওরা স্বার্থলোভি ধান্ধাবাজ। জাতের নামে বজ্জাতি করে। অলীক জাতধর্মকে ভাঙিয়ে খাওয়া- এ ওদের পেশা। 

 

ভীমরাওঃ- তাহলে কী ভাবে এই সঙ্কটের সমাধান হবে প্রভূ ? 

 

বুদ্ধদেবঃ- সংযমি হ। নির্যাতন সহ্য করে মনোবল বাড়া। তবে তো জয়ী হবি। 

 

ভীমরাওঃ- (বিরক্তে) বুঝতে পারছি না- কোন যুক্তিতে অচ্ছ্যুৎ ছোটোজাতের তকমা পেলাম। 

 

বুদ্ধদেবঃ- সব অসার। সাধারণ মানুষকে শোষণ করতে পথে-ঘাটে শিখণ্ডির মতো হাজার গণ্ডা পুতুল খাড়া করে রেখেছে। এটা এই দেব, ওটা ঐ দেবী- এই বাহানায় সারা দেশ চুষে খাচ্ছে। এ স-ব ঐ কু-মতলবীদের মনের বিকার ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। 

 

ভীমরাওঃ- ওদের মতো আমরাও তো মানুষ। তবু আমাদের ছোঁয়ায় ওরা নাকি অশুদ্ধ হয়। আবার শুদ্ধ হতে নদীতে চান করে তুলসিপাতা খায়। এটা কোন যুক্তিতে আছে প্রভু ? কই, ওদের ছোঁয়ায় আমাদের তো কিছু হয় না? 

 

বুদ্ধদেবঃ- সবাই মানুষ। একের ছোঁয়ায় অন্যের অশুদ্ধ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। 

 

ভীমরাওঃ- তাহলে তফাৎ কিসে? ওদের কী এমন জিনিস আছে, যা আমাদের মধ্যে নেই? 

 

বুদ্ধদেবঃ- কিছু নেই, সব জালিয়াতি ব্যবসা। ওরা বহিরাগত চতুর আর্য, আর তোরা বলবান মূলনিবাসী প্রাগার্য। শক্তি থাকতে তবু তোরা হেরে যাচ্ছিস- তফাৎ শুধু এইটুকু। 

 

ভীমরাওঃ- তাহলে এখন কী ভাবে, কোন পথে এর প্রতিকার করবো প্রভু ? 

 

বুদ্ধদেবঃ- ওদের চোখে চোখ রেখে, অন্ধ কুসংস্কার ছুড়ে ফেলে, তোর সমাজকে বাস্তববাদী হতে শেখা। যেদিন এই অজ্ঞ মানুষেরা ওদের ঘোর-প্যাঁচ বুঝতে পারবে- কোনটা মানবিক ধর্ম আর কোনটা অলীক ধর্ম, সেদিন কেটে যাবে সব তমসা। 

 

ভীমরাওঃ- কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়তে আমি তৈরি কিন্তু আমার পিছনে তো কেউ নেই। একা ওদের চাপানো জগদ্দল পাথর সরিয়ে আমি কি আমার সমাজকে জাগাতে পারবো? 

 

বুদ্ধদেবঃ- নিশ্চয় পারবি। কঠিন অধ্যাবসায়ের ফলে বত্রিশটা ডিগ্রী পেয়েছিস। এতেই বুঝতে পারি- তোর মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশাল মানসিক শক্তি। ঐ শক্তিতে একদিন তুই হবি দলিত অচ্ছ্যুৎদের মুক্তিদাতা। এগিয়ে যা। শুরু কর ধর্মযুদ্ধ। কুসংস্কার বর্জন করে প্রতিষ্ঠা কর মানব ধর্মকে। 

 

ভীমরাওঃ- হ্যাঁ, এগিয়ে যাবো। আশীর্বাদ করো প্রভু, আমি যেনো জয়ী হতে পারি। (মাথা নত করে হাঁটু পেতে বসে) 

 

বুদ্ধদেবঃ- (ভীমরাওকে ধরে তোলে) আমার আশীর্বাদ অহরহ তোর সঙ্গে থাকবে বাবা। 

 

ভীমরাওঃ- (চোখ বন্ধ, হাত জড়ো করে জলদ গম্ভীর স্বরে) বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। 

 

বুদ্ধদেবঃ- (ভীমরাওয়ের মাথায় হাত দিয়ে) জয় ভীম। 

 

(ধীরে ধীরে আলো নিভতে থাকে এবং পর্দাও নামতে থাকে) 

       - শেষ - 

 

নলিনী রঞ্জন মণ্ডল। 

শ্যামনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা। 

মোবাইল নং- ৯০৮৮১৭৯৩০৪