click on images to know more about the Images

অচিন্ত্য ও অভিভাবক রশিদ বাবু

Author: পার্থ ঘোষ

বাবাকে অচিন্ত্য হারিয়েছে খুব ছোটবেলায়,তখন তার বয়স সাত কি আট বছর হবে,মায়ের পরিচর্যায় বসুধার চারপাশটার সঙ্গে তার পরিচিতি ঘটছে।এর রূপ,রস, গন্ধ,আলো সে আস্বাদন করতে শিখছে,গায়ে মাখতে শুরু করেছে সবেমাত্র।আজন্ম দারিদ্র্যপীড়িত সে জীবনের সঠিক ঠিকানা খুঁজতে এখনো ব্যস্ত।তার চেয়ে বছর তিন চারেকের ছোট ভাই দীপেন সবসময় তাকে দাদা দাদা করে।ভাইকে অচিন্ত্য সবসময় বুকে আগলে রাখে পাছে মায়ের অসুবিধা না হয় এই ভেবে। 

 

অচিন্ত্য ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করল।জীবন-সমুদ্রের এই 'unfathomable' তল তার পক্ষে খুঁজে পাওয়া ভীষণ কঠিন, এক কথায় কষ্টসাধ্য ,তবুও পথ চলতে পশ্চাৎপদ হলে যে চলবে না,বছর নয় দশকের অচিন্ত্যের মাথায় সেটা রয়েছে।সেখান থেকে তা অপসারিত হয়নি।লড়াইয়ের অপর নাম অচিন্ত্য,হার না মানার আরেক নাম অচিন্ত্য যেন।ভীষণ সাহসী,ছটফটে ও দুরন্ত।

 

এখন পেশায় সে একজন মাংস বিক্রেতা।ছোট ভাই দীপেনকে সে সঙ্গে নিয়েছে,ছেড়ে দেয়নি।ময়নাগড় জেলার সদর বাজারের এক রেলঘুন্টির পাশে তার মাংসের দোকান।বাড়ির খারাপ পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অচিন্ত্যের এই লড়াই।অচিন্ত্য ভীষণ সৎ ও প্রভুভক্ত।একবার কাউকে কোন কথা সে দিলে সে কথার নড়চড় হতো না কখনো।সে চেষ্টা করত তার সাধ্যমত গুরুজনদের কথা রাখার।

 

আর মাংসের দোকানে খদ্দের হয় নানা ধরনের।কারো সঙ্গে অচিন্ত্য কুব্যবহার করে না।প্রত্যেক খদ্দেরই তার ব্যবহার ও কথার মিষ্টতায় সন্তুষ্ট হয়।রশিদবাবুও অচিন্ত্যের দোকানে মাঝে মাঝে মাংস ক্রয় করার নিমিত্ত যান।অচিন্ত্যের কথা ও ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান।মাঝে মাঝে অচিন্ত্যের দোকান হতে মাংস কিনে নিয়ে এসে তিনি অবসর সময়েও তার কথা ভাবেন।

 

একদিন রশিদবাবুর ভারি কৌতূহল হয় অচিন্ত্যের ব্যাপারে।তিনি অচিন্ত্যের কাছে তার বাড়ির ব্যাপার-স্যাপার জানতে চান।অচিন্ত্য রশিদবাবুকে হাসিমুখে বলেন," স্যার আমরা গরীব মানুষ আমাদের কথা শুনে আপনি কি করবেন?"রশিদবাবু তবুও এ ব্যাপারে হাল ছাড়েন না।তিনি অচিন্ত্যের মুখে অচিন্ত্যের বাড়ির কথা শোনেন,শুনে রশিদবাবুর মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।অচিন্ত্যের বাবা রাস্তায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে মারা যান।অচিন্ত্য তখন খুদে,এই নিখিলবিশ্ব বা জগতপ্রপঞ্চের সবকিছু সে চক্ষু মেলে দেখতেই শেখেনি তখনও,চক্ষু তার তখনও নিমীলিত বা "contracted"... এমন এক সময়ে তার মাথার ছাদখানি অপসারিত হয় অর্থাৎ তার বাবা তাদেরকে ছেড়ে চলে যান।

 

যাইহোক সব শুনে রশিদবাবু অচিন্ত্যেকে কিছু না বলে বাড়ি আসেন এবং এসে নানারকম কথা ভাবতে থাকেন।অচিন্ত্য গরীব হলেও সৎ ও সাহসী- এই গুণগুলোর জন্য রশিদবাবু অচিন্ত্যকে মনে মনে ভালোবাসেন ও তার কথা তিনি মাথায় রেখেছেন।

 

প্রতি রবিবার রশিদবাবু অচিন্ত্যের দোকানে মাংস কেনার উদ্দেশ্যে যান।অচিন্ত্য রশিদবাবুকে ভীষণ শ্রদ্ধা করত।রশিদবাবু দোকানে গেলেই তার চিরাচরিত কথা যা রশিদ বাবুর কানে সব সময় বাজে," স্যার কতটা মাংস দেবো?খুব ভালো খাসি রয়েছে,পা থেকে দিই।" ...ইত্যাদি যা রশিদ বাবুর খুব ভালো লাগে শুনতে।

 

একদিন রশিদবাবু মাংসের দোকানে গেছেন কিন্তু মানিব্যাগটা বাড়িতেই ছেড়ে গেছেন।তিনি অচিন্ত্যকে বলেন,"তোর টাকাটা যে আনা হয়নি রে অচিন্ত্য।" অচিন্ত্য তা শুনতে পেয়ে বলে,"কোন ব্যাপার না স্যার ...ও আপনি সময়মতো দিয়ে দেবেন... আপনার ব্যাপার নিয়ে আমি খুব একটা ভাবি না।"- যা শুনে রশিদ বাবু আর বাক্যব্যয় করেন না।এমনিতে অচিন্ত্য মাংসের দোকান আর বাড়ি নিয়ে নিত্য হাড়খাটুনি পরিশ্রম করে থাকে, যা সত্যসত্যই"gruelling"... কেউ তার এই পরিশ্রম দেখলে ও তার সততার কথা শুনলে ওকে চট্ করে অবহেলা করতে সাহস করবে না কোনভাবেই।এতদসত্তেও অচিন্ত্যের মনের"spirit" ছিল"unflinching" বা"indomitable"... যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করার প্রবৃত্তি বা অভীপ্সা তার নেই যেন।

 

এইদিকে একদিন হঠাৎ করে অচিন্ত্য আবিষ্কার করে যে রশিদবাবু কয়েক সপ্তাহ ধরে তার মাংসের দোকানে আসছেন না,সে যেহেতু রশিদবাবুকে মনে মনে খুব শ্রদ্ধা করত তাই একদিন রশিদ বাবুর খোঁজ নিতে রশিদবাবুর বাড়িতেই পৌঁছে যায়।সেখানে গিয়ে দেখে রশিদ বাবুর স্ত্রীর খুব জ্বর।সঙ্গে সঙ্গে অচিন্ত্য মাংসের দোকান ছেড়ে এ ব্যাপারে রশিদবাবুকে যথাসাধ্য সাহায্য করে ও রশিদ বাবুর স্ত্রী আরোগ্য লাভ না করা পর্যন্ত সে রশিদবাবুর বাড়িতে নিয়মিত গিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আসে।এতটাই পরোপকারী ও দয়ালু প্রকৃতির ছিল অচিন্ত্য যা রশিদবাবুকে ছেলেটির সম্পর্কে আরো উচ্চ ধারনা মনে পোষণ করতে বাধ্য করে।

 

এই সমস্ত ব্যাপার অতিক্রান্ত হলে রশিদবাবু আবার অচিন্ত্যের মাংসর দোকানে যান মাংস ক্রয় করতে। সেদিন অচিন্ত্য মাংসের দোকানে ছিল না।ভাই দীপেনের নিকট খোঁজ নিয়ে রশিদবাবু জানতে পারেন যে অচিন্ত্যের মা অনিমাদেবীর ভীষণ অসুখ,তাই অচিন্ত্য মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে চিকিৎসা করাতে।তা শুনে রশিদবাবুর হৃদয় বিগলিত হয় ও তিনি অচিন্ত্যের মাকে দেখতে হাসপাতালে যান।গিয়ে দেখেন অচিন্ত্য মায়ের মাথার নিকট ঠাই দাঁড়িয়ে আছে আর জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে,আর কিছুক্ষণ বাদে ডাক্তারবাবু আসবেন তাই।যাইহোক অভাবের সংসারে অচিন্ত্যের অর্থের সেই সংকুলান ছিল না যে মাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তুলবে।সদর হাসপাতালে ভালো চিকিৎসকরা আছেন ও তাঁরা অচিন্ত্যের মাকে যথাসাধ্য ভালো করার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন।অনিমাদেবী সেই দিন রাত্রি বারোটা একত্রিশ মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করেন।যাওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল রশিদ বাবুর উদ্দেশ্যে," বাবা তুমি অচিন্ত্যকে একটু দেখো ...ওর বাবা তো কবেই চলে গেছেন.. আর আমি...." বলেই অনিমাদেবী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

 

পরদিন সকালবেলা অচিন্ত্য রশিদবাবু ও ভাই দীপেনকে নিয়ে মালতীপুর শ্মশানঘাটে মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে।রশিদবাবু মানে রশিদ খান সাহেব অচিন্ত্যের মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে যথার্থই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন যা অচিন্ত্যের নিকট ছিল এক আশীর্বাদ।

 

মা-বাবা দুজনকে হারিয়ে যদিও অচিন্ত্য কেমন যেন ভাবুক প্রকৃতির হয়ে পড়ে তবুও রশিদ বাবু ও তাঁর ব্যবহার ও সাহায্যের কথা সে বিস্মৃত হয় না।সময়মত সে তার দুঃসময়ের অভিভাবকের নিকট তাঁর তার প্রতি কৃতকর্মের জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকে ও তাঁর আজ্ঞানুবর্তী হয়ে বাকি জীবনটা কঠিন লড়াইয়ের বধ্য ভূমিতে সহাস্যবদনে কাটিয়ে দেওয়ার প্রেরণা সঞ্চয় করে সাহসিকতার সঙ্গে যুঝে ওঠার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়।পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটি ও মাথার উপর"cerulean blue Ambergris"অচিন্ত্যের এই লড়াইয়ের একমাত্র সাক্ষী হয়ে থাকে।পরদিন সকালে রোহিণী নদীর শতদলবেষ্টিত টলমল জলে সূর্যের কিরণের পতনে অচিন্ত্যের জীবনে এক নতুন বাঁকের প্রারম্ভ ঘটে।রশিদবাবু যে তার দক্ষ অভিভাবক অদ্য হতে।