click on images to know more about the Images

জয় ভীম

Author: ঘনশ্যাম মাল

                     মুখ্য চরিত্র

                      ১) বাবাসাহেব

                      ২) গান্ধীজী

                      ৩) রামসে ম্যাকডোনাল্ড

                      ৪) মদনমোহন মালব্য

                      ৫) স্যার জন সাইমন

                      ৬) টিকিধারী ও তার

                      ৭) পেয়াদা

                      ৮) জেলাশাসক

                      ৯) ব্রিটিশ পুলিশ

                      ১০) বালিকা

                      ১১ হাবল (শিশু)

                      ১২) পটলা (শিশু )

                      ১৩) আর্দালি

                      ১৪) গ্রামবাসী ও অন্যান্য

ভূমিকা : জয় ভীম শুধু দুটি শব্দ নয় , এ যেন বিপ্লবের আরেক নাম । বিপ্লবের জয়ধ্বনি। মুক্তির লড়াইয়ে নিপীড়িত জাতির সেতুবন্ধন । জয় ভীম শব্দবন্ধ যেন শোষনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কণ্ঠস্বর । জয় ভীম শব্দে প্রাণবন্ত হয় ম্রিয়মাণ নুব্জ সমাজ । জয় ভীম শব্দে মুখরিত হবে নতুন ভারত ।

ভারতের ইতিহাসে তথা ভারতের মানুষের ইতিহাসে তথা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্কের নাম জাতি ব্যবস্থা ও বর্ণ ব্যবস্থা । এটা শুধু কলঙ্কই নয় ,নিপীড়ন ও অত্যাচারের আরেক নাম জাত ব্যবস্থা ও বর্ণ ব্যবস্থা । মানব সভ্যতার ইতিহাসে সভ্যতার প্রাচীন নিদর্শন যে দেশে গড়ে ওঠেছে, সেখানেই আবার সভ্যতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে । সভ্যতা মানুষই গড়ে তোলে তার মস্তিষ্কের উৎকর্ষতায় । তবে মানুষের মস্তিষ্কে যদি হিংসা, ঘৃণা ও লোভ জন্মায়, তাহলে সভ্য মানুষও হয়ে ওঠে হিংস্র ,ভয়ংকর ও বর্বর । ঠিক সেই রকমই এক বর্বর, ভয়ংকর জাতি ,আর্য-জাতি উত্তর পশ্চিম ভারতে প্রবেশ ক’রে । প্রাচীন ভারতের গৌরবের ও সৌভ্রাতৃত্বের দেশকে বিষিয়ে তোলে যার ফল্গু ধারা ও মুক্তধারা এখনো বহমান । ভারতের মাটিতে সেই বিভেদ বঞ্চনার মুক্তির দূত হিসেবে জন্মেছেন তথাগত গৌতম বুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্রাট অশোক, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর , তিলকা মাঝি, বিরসা মুন্ডা, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল , পঞ্চানন বর্মা, রাইচরণ সর্দার ও সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর । যে ক্ষণে ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর জন্মেছেন তার সমাজ চিত্র আজকের দিনে কল্পনা করে ভীত হতে হয় । বিদেশী শক্তি আর্য জাতি মূল ভারতীয়দের সরলতা দেখে এখানে আধিপত্য স্থাপন করতে ভারতের মূল নিবাসীদের পরাজিত করে বন্দী করে রাখে । বন্দি থেকে গোলাম । গোলাম থেকে দাস । আর সেই দাসত্বের চিরস্থায়ী করতে রচনা করে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থ। তার মধ্যে মনুস্মৃতি সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর ও কুখ্যাত । এরকমই সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যখন ভারত পশ্চাতে অগ্রসর হচ্ছে ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর ভারতের সমাজ ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন । বিদেশে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডঃ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ১৯১৭ সালে একুশে অক্টোবর বোম্বে পৌঁছান । এবং চুক্তি অনুযায়ী বড়োদার মহারাজার সামরিক সচিব রূপে নিযুক্ত হন । কিন্তু অস্পৃশ্য সমাজে জন্ম বলে ঘৃণার শিকার হন , শুরু হয় অমানবিক অত্যাচার ।

প্রথম দৃশ্য

(মঞ্চের দৃশ্য সজ্জা

কয়েকটি চেয়ার ও দুটি টেবিল দুইটি টেবিলেই কিছু কাগজপত্র ও ফাইল এবং আরেকটি টেবিলে জলের বোতল নিচে ডাস্টবিন । টেবিলে একটা কলিং হ্যান্ড বেল)

পিয়নের পোশাক সজ্জিত আর্দালি মঞ্চে প্রবেশ এবং কাগজ ও ফাইল গুলো গুছিয়ে রাখে রাখতে থাকে । এমন সময় বাবাসাহেবের পোশাকে সজ্জিত মঞ্চে প্রবেশ। চেয়ারে বসে টেবিলে কিছু কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে ।

বাবাসাহেব : (হাতে কল বেলটি চাপ দিয়ে) অনুগ্রহ করে ১০ নম্বর ফাইল টা একটু এখানে আনবেন ।

আর্দালি : (ফাইলটা একটু খোঁজাখুঁজি করে বার করে নিয়ে , বাবাসাহেবের টেবিলের দিকে ছুঁড়ে দিলেন) এই নিন ।

বাবাসাহেব : আরে ! তুমি এভাবে কেন দিচ্ছ ! সামনে এসে টেবিলে রাখো ।

আর্দালি : আহা কি আবদার ! জন্মেছেন তো নিচু অস্পৃশ্য জাতে , তার আবার সম্মান !

বাবাসাহেব : তুমি জানো, নিচু জাত কাকে বলে ?

আর্দালি : জানি বৈকি , আপনারাই নিচু জাত ।

বাবাসাহেব : তুমি কি জানো আমি এই অফিসের সামরিক সচিব আর তুমি একজন চাপরাসি ?

আর্দালি : তো কি হয়েছে ? আপনার জন্মই তো হয়েছে নিচু জাতে । তা আপনি সচিবই হোন আর যাই হোন , আমরা হলাম উচ্চ জাতের আর্য গোষ্ঠীর মানুষ । আর আপনারা হলেন নিচু জাতের মানুষ ।

 বাবাসাহেব : তুমি জানো না , তুমিও একজন মানুষ আমিও একজন মানুষ ? আর একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে যে ঘৃণা করে সে কখনোই উচ্চ জাতের হতে পারে না ।

আর্দালি : মশাই, আপনি কি জানেন না ? ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে । ব্রাহ্মণ জন্ম গ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সমস্ত মানুষের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মানুষ ?

বাবাসাহেব : ও-- তাহলে তুমি মনুস্ংহিতার কথা বলছো ?

আর্দালি : অতশত আমি জানিনা , কোন্ বইয়ে লেখা আছে । তবে এটুকু জানি আমরা উঁচু জাতের আর আপনারা নিচু জাতের ।

(কথার ফাঁকে বাবাসাহেব কাজ করতে করতে উঠে গিয়ে অন্য টেবিলে রাখা জলের পাত্র থেকে জল পান করতে উদ্যত হবেন )

বাবাসাহেব : তোমার একটু জল পান করছি ।

( তৎক্ষণাৎ আর্দালি প্রায় দৌড়ে গিয়ে জলের পাত্র কেড়ে নেবে )

আর্দালি : আরে, আরে মশাই কি করছেন ! এই রে !(অবজ্ঞা প্রকাশ করে জলের পাত্র কেড়ে নিয়ে সেখানে ডাস্টবিনে সব জল ঢেলে দিলেন আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন ) এখন আবার আমাকে গোমূত্র ও গোবর দিয়ে এই পাত্রটাকে শুদ্ধ করতে হবে ।

বাবাসাহেব : শোনো হে মূর্খ তোমার পূর্বপুরুষ এই ভারতে এসেছিল যাযাবরের মতো । তৈরি থেকো আবার ফিরে যাওয়ার জন্য । (নিজের টেবিলে ফিরে এসে একটি কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে কিছু একটা সই করে প্রস্থান করলেন)

আর্দালি : নিচু জাতের লোক হয়ে আবার বড় বড় কথা ( জলের পাত্রটাকে মুছতে মুছতে প্রস্থান)

দৃশ্য ২

ব্যাকগ্রাউন্ড

বাবাসাহেব একদিন চূড়ান্তভাবে অপমানিত হলেন । তিনি যে পার্সি হোটেলে উঠেছিলেন সেখানকার সবর্ণ লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয় । জানতে চায় আসলে তিনি কে ? (সকলের মঞ্চে প্রবেশ )

লাঠি হাতে লোকজন : তুই কে ? তোর জাতের পরিচয় দে ।

বাবাসাহেব : আমি একজন হিন্দু ।

লাঠি হাতে লোকজন : কিন্তু আমরা শুনেছি, তুই যে মাহার- চামার !

বাবাসাহেব : কিন্তু আমি তো হিন্দু !

লাঠি হাতে লোকজন : এই ছোটলোক নিচু জাত । তুই এখান থেকে তলপি তলপা নিয়ে এই মুহূর্তেই বেরিয়ে পর, নইলে তোর দেহে আর প্রাণ থাকবে না ।

বাবাসাহেব : কিন্তু আমার অপরাধ ?

লাঠি হাতে লোকজন : (উত্তেজিত হয়ে) এই নিচু জাতের বাচ্চা , তুই জানিস্ না এই এলাকায় কোন নিচু জাত বাস করে না ।

 বাবাসাহেব : আচ্ছা আমাকে একটু সময় দিন ।

(বাবাসাহেব একটি ব্যাগে কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে ভর্তি করতে থাকে । অপমানিত -লাঞ্ছিত -ঘৃণিত হয়ে বেরিয়ে পড়েন ।

লাঠি হাতে লোকজন : শালা নিচু জাতের সাহস বড্ড বেড়ে গেছে । (প্রস্থান)

 

দৃশ্য তিন

ব্যাকগ্রাউন্ড

(বাবাসাহেব ভাবতে লাগলেন একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ শহরের এরকম সরকারি অফিসে যদি সামাজিক চিত্র হয় , তাহলে গ্রামীণ সমাজের নিরক্ষর মানুষদের কি অবস্থা !) (দুই বালক গলায় ঘট ও পেছনে ঝাড়ু বেঁধে খোলামকুচি নিয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে খেলতে মঞ্চে প্রবেশ । ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ঘোষিত হয় মন্দিরের প্রাঙ্গণে দুই অস্পৃশ্য জাতির শিশু খেলা করে)

পটলা : ( খোলামকুচি মঞ্চে ছুড়ে দিয়ে এক পা তুলে ,এক পায়ে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে) কিত্ কিত্ কিত্ কিত্ কিত্ কিত্ কিত্

হাবল : আউট আউট ।

পটলা : এই নে , তোর চাল্ ।

হাবল : কিত্ কিত্ কিত্ কিত্ কিত্ কিত্ কিত্

হাবল : আউট আউট।

পটলা : এই হাবল , আমি খুব ক্লান্ত । একটু মন্দিরের ছায়ায় বসি । তুই খেল , আমি ওখান থেকে বসে বসেই দেখি ।

হাবল : ঠিক আছে , যা ।

পটলা : ( মন্দিরের উঠোনে এসে বসে । ) আহ্ কী আরাম !

( যেই মন্দিরে উঠেছে , চিৎকার করে পেয়াদার প্রবেশ

পেয়াদা : কে রে ওখানে ? (এমন সময় হাবল দৌড়ে পালায় )

পেয়াদা : এই শোন্ , দাঁড়া । (পেয়াদা দৌড়ে গিয়ে পটলাকে ধরে ।)

 পটলা : বাবু আমাকে ছেড়ে দিন । আমি আর কোনদিন আসবো না , কোনো দিন মন্দিরে উঠব না । ছেড়ে দিন বাবু ।

(মঞ্চে এক টিকিধারীর প্রবেশ ।)

 টিকিধারী : এ কে রে ?

পেয়াদা : দেখুন না বাবু ব্যাটা পাজিছেলে , মন্দিরে ঢুকেছিল ।

পটলা : ছেড়ে দিন বাবু , আর কোনদিন মন্দিরে ঢুকব না । ছেড়ে দিন আমাকে ।

টিকিধারী : কার ছেলে তুই ?

পটলা : বিমল ডোম ।

টিকিধারী : চাবুকটা আন্ । ( এক হাতে বাচ্চাটির হাত ধরে অন্য হাতে আঙুল দিয়ে পেয়াদাকে নির্দেশ দেয় । তৎক্ষণাৎ পেয়াদা চাবুক নিয়ে আসে)

 টিকিধারী : শালা ডোমের ছেলে । অপবিত্র -নিচ্ -অধম ,মন্দিরে ঢোকার সাহস পেলি কোথায় ! (চাবুক মারতে থাকে ও পটলা আর্তনাদ করতে থাকে । টিকিধারী মাটিতে ফেলে তাকে মারতে থাকে । একপর্যায়ে এসে নিস্তেজ হয়ে ওঠে পটলা)

পেয়াদা : বাবু শেষ !

টিকিধারী : (কেদারায় বসল) পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে আয় ।

(পেয়াদা পটলাকে একরকম টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে প্রস্থান করে । কিছুক্ষণ পর আবার আসে ।)

পেয়াদা : বাবু কি হবে ?

টিকিধারী : কিচ্ছুটি হবে না । তুই মুখ বন্ধ রাখ ।

(এমন সময় দূর থেকে এক নব যৌবনা মহিলার কন্ঠস্বর প-ট-ল , প-টল পটল ভাই । বলতে বলতে মঞ্চের সামনে দিয়ে যায় । গলায় ঘট ও পেছনে ঝাড়ু বেঁধে)

টিকিধারী : কার মেয়ে রে ওটা ?

পেয়াদা : আজ্ঞে কত্তা , ওই বিমলেরই হবে মনে হয় ।

টিকিধারী : ( পেয়াদাকে ইশারা করলেন মেয়েটাকে এদিকে আনতে)

পেয়াদা : এই মেয়ে শোন্ । তোর ভাই এদিকে আমাদের বাবুর বাগান বাড়ির পেয়ারা কুড়োতে এসেছে। আয় তুইও দুটো নিয়ে যা ।

মেয়ে : কই ? ( পর্দার আড়ালে যাবে)

টিকিধারী ( কেদারা থেকে উঠে পর্দার আড়ালে যাবে । তারপর মেয়েটি আর্তনাদ করতে থাকবে। কিছুক্ষণ পর টিকিধারী ধুতি গোছাতে গোছাতে আবার মঞ্চের সামনে আসবে ।)

পেয়াদা : বাবু এবার কি হবে ?

টিকিধারী : কিচ্ছু হবে না । ওকেও ফেলে দিয়ে আয় । (দুজনেই প্রস্থান)

দৃশ্য চার

ব্যাকগ্রাউন্ড

(এরকম একটা সমাজের পরিত্রাতা হিসেবে রুখে দাঁড়ালেন বাবাসাহেব ডক্টর ভীমরাও আম্বেদকর । ১৯২৭ সালের ২০ মার্চ চৌদা পুকুরের জলপানের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হল । তার পূর্ব প্রস্তুতি নিতে এক সভায় বাবাসাহেবের জ্বালাময়ী ভাষণ ।

মঞ্চে কিছু দর্শক সাধারণ ও বাবাসাহেবের আগমন । বাবাসাহেব আসন গ্রহণ করলেন । দর্শক সামনে উপবিষ্ট হন ।)

বাবাসাহেব : সভায় উপস্থিত আমার ভাই ও বোনেরা , তোমরা জানো যে আমাদের সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে বঞ্চিত- নিপীড়িত -কলঙ্কিত ও লাঞ্ছিত । যেখানে আমার ভাই বোনেরা কুকুর ইতর প্রাণীর থেকেও বেশি ঘৃণিত হয় । দাসত্বের শিকল পরিয়ে অস্পৃশ্য করে রেখেছে আমার ভাই-বোনেদের , আমার এই সমাজকে । তোমরা যদি এ সমাজের উন্নতি চাও, যদি মুক্তি চাও, যদি পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে চাও ,তবে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লড়াইয়ের মাধ্যমে তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে । ক্ষমতার সিংহাসনে আজকে যারা আসীন ,তারা তোমাদেরকে তার আসন ছেড়ে দেবে না কখনোই , কোনোভাবেই । সুতরাং তোমাদেরকেই দায়িত্ব নিতে হবে সংগ্রামের মাধ্যমে । আমার ভাই ও বোনেরা, কোন কাজ না করে জড় পদার্থের মত বা বৃক্ষের মতো হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে মহৎ কাজে জীবন উৎসর্গ করা অনেক ভালো । যদি তোমরা পরিপূর্ণ রূপে বিশ্বাস রাখো যে তোমাদের কাজ ন্যায়সঙ্গত, তবেই তোমরা তা করবে । আমরা চাই সেই মানুষ, যারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে , হিংসা-ঘৃণা দূর করার জন্য যারা আত্মোৎসর্গ করতে পারবে । আমরা আগামী ২০ মার্চ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মাধ্যমে মহাদের চৌদা পুকুরে জল পান করে প্রতিবাদ করব । এতকাল চৌদা পুকুরে জল পান করিনি বলে আমরা মরে যায়নি । আমরাও মানুষ তা প্রমাণ করার জন্য চৌদা পুকুরে যেতে চাই । আমার ভাই ও বোনেরা , এই সত্যাগ্রহ পরিচালনায় গোলমাল সৃষ্টি করতে পারে ওরা । প্রতিরোধ করতে ওরা পরিকল্পনা গ্রহণ করবে সেটা নিশ্চিত । সরকার যদি সত্যাগ্রহ নিষিদ্ধ করে সে ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সত্যাগ্রহীদের কারাবরণ করতে হতে পারে । তোমাদের তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে । অস্পৃশ্যতা এক ঘৃণার বৃক্ষ ,তা নির্মূল করতে হবে জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে । কোনো প্রকার দিন যাপন করে কাকের মতো হাজার বছর বেঁচে থাকার কোন মানেই হয়না ।

জনতা : জয় ভীম । জয় ভীম । আমরা পুকুর দখল না করা পর্যন্ত গ্রামে মুখ দেখাবো না । জয় ভীম ।

পঞ্চম দৃশ্য

( বাবাসাহেবের ঘোষণার কয়েকদিন পরেই বীরেশ্বর মন্দিরে বর্ণবাদীরা সভা করেন এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে । মঞ্চে কয়েকজন টিকিধারী প্রবেশ । একজন মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসলেন । বাকিরা সামনে বসলেন ।)

টিকিধারী :( দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন) নমস্কার সুধীবৃন্দ । আপনারা এখানে সকলে সমবেত হইয়াছেন তাহার কারণ সম্পর্কে সকলেই প্রায় অবগত আছেন । আপনারা জানেন যে নীচ্ অধম মাহার জাতির উঠতি নেতা আম্বেদকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে আগামী ২০ মার্চ আমাদের সকলের পবিত্র পানীয় জলের আধার চৌদা পুষ্করে গিয়া অপবিত্র করিবার । বন্ধুগণ ,এই নিচু জাতের মানুষের এই পরিকল্পনা আমাদেরকে যেকোনোভাবেই ব্যর্থ করিতে হইবে ।

সামনে বসে থাকার টিকিধারী কয়েকজন : জী আজ্ঞা প্রভু , কী করিতে হইবে আপনি সেই আদেশ দিন ।

টিকিধারী : আমরা প্রথমে জেলা আধিকারিক ও সরকারি দপ্তরে স্মারক দিয়া জানাইয়া দিতে চাই , এই নিচ্ অধম জাতি আমাদের গরিমা ও আর্য জাতির ঐতিহ্য নষ্ট করিতে চেষ্টা করিতেছে । আমরা দেখিতে চাই সরকার কীরূপ ভূমিকা পালন করিতেছে । আর সরকার যদি কোনো সদর্থক্ ভূমিকা পালন করিতে ব্যর্থ হয়, তবে আমাদেরকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতে হইবে । প্রয়োজনে ধর্মীয় আবেগ উস্কানি দিয়া গন্ডগোল সৃষ্টি করিতে হইবে, যাহাতে উহাদের এই প্রচেষ্টাকে আমরা প্রতিহত করিতে পারি ।

কয়েকজন টিকিধারী : জয় হোক । আর্য জাতির জয় হোক । (সকলেই প্রস্থান)

(ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ঘোষিত হয় জেলা শাসক পরিদর্শনে এলেন সঙ্গে দুজন পুলিশ । মঞ্চে জেলাশাসক ও পুলিশ আগমন তৎক্ষণাৎ টিকিধারীদের আগমন ।

কয়েকজন টিকধারী : স্যার , আপনি আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা করিবেন সেই আশায় আপনার শরণাপন্ন হইয়াছি । আপনি অবগত হইয়াছেন যে মাহাদে আমাদের পবিত্র পানীয় জলের আধার চৌদা পুষ্কর । সেখানে মাহারদের মতন নিচু জাতের লোকেরা অপবিত্র করিবার জন্য আম্বেদকরের নেতৃত্বে কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে । আপনি আইনী নোটিশ দিয়া এই প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করিবেন সেই আবেদন রাখিতেছি ।

জেলা শাসক : আমি ইতিমধ্যেই ডঃ আম্বেদকরকে তাদের প্রস্তাবিত সত্যাগ্রহ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছি । পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের মাধ্যমে চিঠিও পাঠিয়েছি । আপনারা শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন । (প্রস্থান )

টিকিধারী : আমরা শুনিয়াছি উহারা উক্ত স্থানে তাবু খাটাইবে । আমাদের জমি যাহাতে ব্যবহার করিতে না পারে তাহার আইনি বন্দোবস্ত করিতে হইবে । আমাদের স্থানীয় ব্যবসায়ীগণ সম্মেলনের সাথে যুক্ত কোনো ব্যক্তিকে কোনো কিছু বেচাকেনা করিবে না এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল ।

সমস্ত টিকিধারী : তাহাই হইবে প্রভু।

 

ষষ্ঠ দৃশ্য

Background থেকে ঘোষিত হবে ২৯২৭ সালে ২০ মার্চ সকালে বাবাসাহেব আম্বেদকর ২০০ প্রতিনিধি নিয়ে দাসগাও স্টেশনে নামলেন । সেখান থেকে পৌঁছলেন জেলাশাসকের অফিসে । তারপর সেখান থেকে পৌঁছলেন এক মুসলমানের জমিতে তৈরি করা তাঁবুতে । তখন প্রায় ১৫ হাজারের মতো মানুষ জয়ধ্বনিতে মুখরিত করছে চারিদিক । (বাবাসাহেব ও কয়েকজন মঞ্চে প্রবেশ)

বাবাসাহেব : আমার ভাই ও বোনেরা, তোমাদের এই আত্মগৌরবের জন্য লড়াই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে । আজকে চৌদা পুকুরের জল যেটা কুকুর বেড়ালেও পান করতে পারে অথচ আমার সমাজের মানুষ তৃষ্ণায় আর্তনাদ করলেও তা পান করতে পারেনা । যারা এই জঘন্য -ঘৃণ্য ও নৃশংস কাজ করতে পারে, সেই আর্য জাতির সংস্কৃতিকে আমরা ধিক্কার জানাই । আমরা আজকে জানিয়ে দিতে চাই এই ভারতের মাটি ,এই ভারতের জল, এই ভারতের আকাশ- বাতাস একসময় আমাদেরই ছিল । এই ভারতে বিভেদের কোনো স্থান নেই । তোমরা জানো ওই বর্বর চক্রান্তকারীরা কয়েক দিন আগে থেকেই আমাদের এই আন্দোলনকে বয়কট করেছে । তবুও তোমরা দূর-দূরান্ত থেকে খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে এনে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছ , তার জন্য তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না । বরং তোমাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধিকার চেতনা উন্মেষের চেষ্টাকে আমি কুর্নিশ জানাই । চলো সকলে মিলে, ধীরে ধীরে চৌদা পুকুরের দিকে এগিয়ে চলি ।

সকলে : জয় ভীম । জয় ভারত । জয় শিবাজী মহারাজকি জয় ।

(মঞ্চে সবাই একটু ঘোরাঘুরি করে পুকুরের জল পান করার অভিনয় করবেন এবং স্লোগান দিতে থাকবেন জয় ভীম , জয় ভীম । কিছুক্ষণ পর বাবাসাহেব আবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন)

বাবাসাহেব : আমার ভাই ও বোনেরা , আমাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যই ছিল অস্পৃশ্যতা -ঘৃণা ও হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । তোমরা সকলেই জানো ব্রিটিশ সরকার দেওয়ানী ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও সামাজিক ব্যবস্থার দায়িত্বভার এখনো ওই বর্বরদের হাতেই থেকে গেছে । ব্রিটিশ আইনে রাষ্ট্র পরিচালিত হলেও সমাজনীতি চলে মনু সংহিতার নিয়মে । তাই আমরা শপথ নেব এত জঘন্য- কুখ্যাত - বৈষম্যের আধার এই মনুসংহিতার সমাজ ব্যবস্থাকে অমান্য করার । প্রয়োজনে তা ধ্বংস করার ।

সকলেই : জয় ভীম । জয় ভারত ।

(সকলের প্রস্থান করে )

( কয়েকজন টিকিধারী প্রবেশ)

টিকিধারী : অস্পৃশ্যদের স্পর্শে আমাদের সকলের পবিত্র পুষ্করের জল অপবিত্র হইয়াছে । উক্ত পুষ্করের জল এখন বিশুদ্ধ করিতে হইবে । ইহার একমাত্র উপায় হইল গোময়, গোমূত্র, দধি, দুগ্ধ ও ঘৃত উক্ত পুষ্করের জলে মিশ্রিত করিতে হইবে ।

আরেক টিকিধারী : আজ্ঞে প্রভু তাহাই হইবে ।

টিকিধারী : আমরা একশত আট কলসি জল পুষ্কর হইতে ফেলিয়া দিব । উক্ত কলসি গুলো গোময়, গোমূত্র, দধি, দুগ্ধ ও ঘৃত পরিপূর্ণ করিয়া মন্ত্র পাঠের মধ্য দিয়া পুষ্করের জলে মিশ্রিত করিব । ইহাতেই জল শুদ্ধ হইবে । সকলে পুষ্করের দিকে অগ্রসর হন । (সকলে প্রস্থান )

( ব্যাকগ্রাউন্ড ঘোষণা : এভাবেই গোঁড়া বর্ণবাদীরা সেদিন পুকুরের জল শোধন করেন । এদিকে ১৯২৭ সালে ২৫ শে ডিসেম্বর বাবাসাহেব অস্পৃশ্যদের নিয়ে সভা করেন )

(বাবাসাহেব ও কয়েকজন প্রবেশ )

বাবাসাহেব : আমার ভাই ও বোনেরা , আপনারা শুনেছেন যে গোরুর মল - মূত্র দিয়ে চৌদা পুকুরের জল শুদ্ধিকরণ করেছে গোঁড়া বর্ণবাদীরা । এই কাজ হাস্যকর ও লজ্জার । যে ভয়ংকর কুখ্যাত গ্রন্থের নিয়ম নীতির কারণে এই সমাজ পশ্চাতে অগ্রসর হচ্ছে , সেই কুখ্যাত গ্রন্থের নাম মনুসংহিতা । যেখানে আমাদের মতো মানুষকে কুকুর শিয়ালের থেকেও অধিক ঘৃণিত হতে হচ্ছে । সমস্ত রকমের ঘৃণার আধার এই কুখ্যাত মনুসংহিতা । তাই এই ব্রাহ্মণ্য নিয়ম-নীতির কুখ্যাত গ্রন্থ , বৈষম্যের প্রতীকী দহন করে প্রতিবাদ জানাতে চাই ।

কয়েকজন : জয় ভীম । জয় ভীম । ( কয়েকজন কিছু কাগজে আগুন ধরিয়ে দেন ।)

     গান

সপ্তম দৃশ্য ( মঞ্চের চেয়ার টেবিল সজ্জিত)

ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘোষিত হবে ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড ভারত শাসন আইনের পর্যালোচনা ও ভারতীয়দের সমস্যার কথা ও দাবি মেনে সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৯২৮ সালে সাত সদস্যের কমিশন ভারতে আসে। যার চেয়ারম্যান ছিলেন স্যার জন সাইমন , যিনি ছিলেন এক দক্ষ সংবিধান বিশেষজ্ঞ । ভারতের হিন্দু মহাসভা, জাতীয় কংগ্রেস, মিল মালিক সংঘ, বণিক ফেডারেশন এই কমিশনকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিল । সাইমন কমিশন ১৯২৮ সালে ৩রা ফেব্রুয়ারি বোম্বে পদার্পণ করলে ‘গো ব্যাক সাইমন’ স্লোগান তোলে । তা সত্ত্বেও কমিশন অন্তর্তদন্ত চালায় এবং এ সময়ে বাবাসাহেব তার বহিষ্কৃতকারিনী সভা ও দলিত শ্রেণীর ১৮টি সংস্থা স্মারকলিপি দেন । ১৯২৮ সালে ২৩ শে অক্টোবর কেন্দ্রীয় কমিটি ও বোম্বের প্রাদেশিক কমিটি পুনাতে বাবাসাহেবের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ।

 (স্যার জন সাইমন , হরি সিং গৌড় ও বাবাসাহেব আম্বেদকরের প্রবেশ)

বাবাসাহেব : স্যার ,জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কথায় আমাদের সমাজকে বঞ্চিত করবেন না । আমরা আপনাদের মাধ্যমে জানাতে চাই, বৈদিক ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রী সমাজ ব্যবস্থার হিংস্র রূপ সম্পর্কে । আমরা চাই প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন সভায় অস্পৃশ্য করে রাখা সমাজের পর্যাপ্ত প্রতিনিধি , সেই সাথে নিপীড়িত এই depressed classes এর শিক্ষা ও চাকুরিতে অধিক সুযোগ । আমরা চাই , প্রাপ্ত বয়স্কের ভিত্তিতে সকলের ভোটাধিকার ।

সাইমন : Dr. Ambedkar ,do you want the equal rights for everyone in the election?

বাবাসাহেব : Yes sir, we want . সেইসাথে আমরা চাই অস্পৃশ্য করে রাখা সমাজের সরকারি চাকরিতে পর্যাপ্ত সুযোগ ।

সাইমন : Dr. Ambedkar can you give the real definition of the depressed classes ?

বাবাসাহেব : Yes sir .যে জাতিগুলো হাজার হাজার বছর ধরে এই ভূখণ্ডে বসবাস করছে , যাদের সারল্যের সুযোগে আর্য গোষ্ঠী তার চাতুর্যে সমস্ত রকমের সামাজিক অধিকার , শিক্ষার অধিকার, সম্পদের অধিকার, কেড়ে নেওয়া হয়েছে , সেই সকল আদি নাগরিক সমাজই বর্তমানে Depressed classes .

সাইমন : Would you like to object that the depressed classes would be governed by Hindu law ?

বাবাসাহেব : Yes sir .যে আইনে দুটো সমাজকে একই অপরাধে ভিন্ন শাস্তি প্রদান করে , তা পক্ষপাত দুষ্ট । যে আইনের শাসনে একশ্রেণীর মানুষকে কুকুর শিয়ালের থেকেও বেশি ঘৃণিত হতে হয় । যে আইনের শাসনে এক শ্রেণীর শিক্ষার- বাসস্থানের- পোশাকের স্বাধীনতা নেই, সেই মনুর আইনের শাসন আমরা চাই না ।

সাইমন : Thank you Dr. Ambedkar .

বাবাসাহেব : Thank you so much honourable chairman . ( সকলেই প্রস্থান)

অষ্টম দৃশ্য

Background জাতীয় কংগ্রেস ও সবর্ণদের বিভিন্ন সংগঠনের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় সাইমন কমিশনের রিপোর্ট , যেখানে বাবাসাহেবের প্রায় প্রতিটি দাবিই গৃহীত হয় । ঘোষিত হয় ভারতীয় প্রতিনিধি ও ব্রিটিশ সরকার এবং বৃটেনের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারতের দাবি পূরণের জন্য ভারতের সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে লন্ডনে একটি গোল টেবিল বৈঠক আয়োজিত হবে । ১৯৩০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাবাসাহেব আমন্ত্রণ পেলেন এবং ৪ অক্টোবর লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ১৮ অক্টোবর লন্ডনে পৌঁছান । ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ডের সভাপতিত্বে ১৯৩০ সালের নভেম্বর মাসের ১২ তারিখ প্রথম গোল টেবিল বৈঠক শুরু হয় এবং ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত বৈঠক চলে । উক্ত বৈঠকে ডঃ আম্বেদকর ভারতের অস্পৃশ্য জাতির তথা Depressed classes'র জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি জানান । জাতীয় কংগ্রেস প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করেনি ।

ওই বছরেই ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে পয়লা ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকের অধিবেশন হয় । জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গান্ধীজী এবার যোগদান করলেন । সেই সাথে জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতা মদনমোহন মালব্য সহ বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে আরও ১২৫ জন যোগদান করলেন ।

মঞ্চ সজ্জা (গোলটেবিল এর চারপাশে চেয়ার সামনে সভাপতির চেয়ার । ম্যাকডোনাল্ড , বাবাসাহেব , গান্ধীজি , মদনমোহন মালব্য ও অন্যান্য সদস্য প্রবেশ করে সকলে আসন গ্রহণ করেন ।

রামসে ম্যাকডোনাল্ড : I'm starting the business of the meeting with expressing my sincere greetings and thanks to everyone. এই বৈঠকের প্রধান কাজ প্রথম অধিবেশনের সাবকমিটি গুলি যে রিপোর্ট দাখিল করেছে সেগুলির পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ । Now I would request Mr. Gandhi to speak.

গান্ধীজী : সম্মানিত সভাপতি মহাশয় , আজকের বৈঠকে উপস্থিত সকল সদস্যবৃন্দ , প্রত্যেকে আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি । মহামান্য সভাপতি মহাশয় আপনি অবগত আছেন যে , ভারতের একমাত্র জাতীয় প্রতিনিধি আমি এবং আমি ভারতের Depressed classes এর উপযুক্ত এবং একমাত্র প্রতিনিধি । পূর্বে জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধীতা সত্ত্বেও সাইমন কমিশনে ডঃ আম্বেদকর সকলের জন্য ভোটাধিকার ও Depressed classes’র জন্য আলাদা প্রতিনিধিত্বের দাবি করেন । প্রথম বৈঠকে জাতীয় কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে মূল আলোচনায় তার উপস্থাপন হয় এবং গৃহীত হয় । কিন্তু বর্ধিত এই সভার কাছে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করে উক্ত বিষয়ের তীব্র বিরোধিতা করছি । আমার দেশের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মানুষেরা এখনো ভোটাধিকারের গুরুত্ব বুঝে উঠতে সক্ষম হননি । ফলে সকলের ভোটাধিকার দিলে তা প্রভাবিত করে গণতন্ত্রকে বিপথগামী করা সহজ হবে । তাই আমি এর বিরোধিতা করছি । দ্বিতীয় পয়েন্ট : ভারতের সমাজ এক অবিভক্ত সমাজ । ডক্টর আম্বেদকর প্রস্তাবিত ডিপ্রেসড ক্লাসের আলাদা প্রতিনিধিত্ব তথা আলাদা নির্বাচনী ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করছি । আলাদা প্রতিনিধিত্ব ও নির্বাচনী ব্যবস্থা দেশের সমাজকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেবে । এটা হবে আত্মহত্যার সমান । ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সমস্ত জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করবে ও সমান গুরুত্ব দেবে । তাই এর প্রতি জাতীয় কংগ্রেস দায়বদ্ধ । ডঃ আম্বেদকরের এই প্রস্তাবকে আমি সর্বতোভাবে বিরোধিতা করছি । ধন্যবাদ ।

রামসে ম্যাকডোনাল্ড : Thank you Mr. Gandhi . Now I would like to request Dr. Ambedkar to speak.

বাবাসাহেব : Respected president and all the members of the House . প্রথমেই বলি মহাত্মারা চলমান প্রেতাত্মার মত শুধু ধুলি উড়িয়েছেন কিন্তু মানুষের কোনো উন্নতি করতে পারেননি । মিঃ গান্ধী এ কথা সত্য যে , আমার জন্মের আগে থেকেই আপনি অস্পৃশ্যদের সম্পর্কে ভাবছেন , অথচ এই অস্পৃশ্য সমাজের সঙ্গে এখনো কুকুর বেড়ালের মত ব্যবহার করা হয় । যেখানে জল পান করার মতো অধিকার টুকু পর্যন্ত আমরা পাই না । সেই সমাজের দায়িত্ব অন্য সমাজের নেতার হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ বেড়ালকে মাছের উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান করার সমান । অত্যাচারীরা কখনোই মুক্তিদাতা হতে পারেনা । তাই আমরা চাই , আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি ও আলাদা নির্বাচনী ব্যবস্থা । সনাতনী মূল ভারতীয় সমাজকে গণতন্ত্রের পাঠ দেওয়া কি মুর্খামি নয় ? আর আমার সমাজ নিরক্ষর হলেও নিশ্চয়ই একদিন বুঝবে তার স্বার্থ সুরক্ষার ভার কার হাতে তুলে দেওয়া উচিত । তাই স্বতন্ত্র নির্বাচনী ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভারতের মূলনিবাসী সমাজ তাদের প্রকৃত প্রতিনিধিকে আইন সভায় পাঠাতে চায় । রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক মহা চাবি যার দ্বারা সমস্ত দরজার বন্ধ তালা খোলা যায় ।

মদনমোহন মালব্য : ( বাবাসাহেবের বক্তব্যের মাঝে পাশ থেকে টিপ্পনী) ডঃ আম্বেদকর , সমাজ শিক্ষায় আলোকিত হলেই জাত-পাত উঠে যাবে ।

বাবাসাহেব : ( টেবিলে রাখা জলের বোতল মালব্যের দিয়ে বাড়িয়ে দিলেন ) পান করুন মিঃ মালব্য । ( মালব্য হাতের ইশারায় অবজ্ঞা করেন ও মুখ বিকৃত করে জানিয়ে দেন তিনি পান করবেন না ।) জানি আপনি পান করবেন না । এই গ্রহের মধ্যে আমি সবথেকে বেশি শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে আজও অস্পৃশ্য বলে বিবেচনা করা হয় । তাহলে ডিপ্রেসড ক্লাসের নিরক্ষর মানুষদের কী অবস্থা হয় ! ফলে প্রকৃত প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমেই সমাজকে উন্নত করা সম্ভব বলেই আমি মনে করি । সকলকে ধন্যবাদ ।

রামসে ম্যাকডোনাল্ড : Thank you Dr Ambedkar. After hearing everyone's speech, the meeting is adjourned for today. (সকলেই প্রস্থান )

 

নবম দৃশ্য

ব্যাকগ্রাউন্ডে : গোলটেবিল বৈঠকের বক্তব্যে বাবাসাহেবের ঝাঁঝালো যুক্তির কাছে সেদিন গান্ধীজী উন্মোচিত হয়ে যান । গান্ধীজীও মুসলিম লীগের সদস্যদের সাথে গোপন আলোচনায় তাদের ১৪ দফা দাবি মেনে নেবার শর্তে বাবা সাহেবের বক্তব্যের বিরোধিতা করার প্রস্তাব দেন । কিন্তু তাঁর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় । হতাশ হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরেন । সেদিন বাবাসাহেবের যুক্তি ও বিচক্ষণতায় সমাজের আসল চিত্র ভেসে ওঠে ও তা গৃহীত হয় । গান্ধীজী দেশে ফিরে অস্পৃশ্যদের আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থার প্রচেষ্টাকে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শুরু করেন আমরণ অনশন , যিনি অস্পৃশ্যতা দূর করার জন্য কক্ষনো কোনোদিনও অনশন করেননি । এমত অবস্থায় মদনমোহন মালব্য গান্ধীজীর জীবন রক্ষার্থে বোম্বেতে এক সম্মেলন ডাকেন ও বাবাসাহেবকে বার্তা দেন । আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় ব্রিটিশ সরকার গান্ধীজীকে কারারুদ্ধ করেন ।

(এক সাংবাদিক ও বাবাসাহেবের প্রবেশ । বাবাসাহেব চেয়ারে বসেন । সাংবাদিক সামনে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিয়ে)

 সাংবাদিক : গান্ধীজি গত ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরণ অনশন করছেন এবং এজন্য জাতীয় কংগ্রেস নেতারা আপনাকে দায়ী করছেন । আপনি এ ব্যাপারে কী বলবেন ?

বাবাসাহেব: মহাত্মারা অমর নন । কিংবা কংগ্রেসও নয় । ভারতে অনেক মহাত্মা জন্মেছেন ,এসেছেন আবার চলে গেছেন । কিন্তু অস্পৃশ্যরা অস্পৃশ্যই থেকে গেছেন । আমি দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই , কোনভাবেই এই অস্পৃশ্য শ্রেণীর অধিকার খর্ব করতে রাজি নই ।

সাংবাদিক : ধন্যবাদ স্যার । (প্রস্থান)

(বাবাসাহেব প্রস্থান করতে উদ্ধত ,এমন সময় এক দল টিকীধারী আগমন । প্রস্থানের পথ আটকে । বাবাসাহেব পিছিয়ে এলেন)

টিকিধারী : তোর জন্য আজ মহাত্মাজী মরতে বসেছেন । যদি ওঁর দাবী না মেনে নিস্ তো সব জ্বালিয়ে দেব । তোর অস্পৃশ্য সমাজের মানুষজন আরো ভয়ঙ্কর রূপ দেখবে ।

বাবাসাহেব : আমার প্রাণের বিনিময়েও আমি আমার সমাজের এই অধিকার নষ্ট হতে দেব না ।

অন্য টিকিধারী : তোর সমাজের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব । তোকে একদিনের বেশি সময় দেবো না । তোকে গান্ধীজীর দাবি মেনে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতেই হবে ।

বাবাসাহেব : তা কোনভাবেই সম্ভব নয় । ( প্রস্থান উদ্যত)

টিকিধারী : অপেক্ষা কর্ , সূর্য উঠলেই শুনতে পাবি আমাদের নেতারা তোর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে । ( প্রস্থান)

(বাবা সাহেব দুঃখ ও হতাশ গ্রস্ত মুখে প্রস্থান)

 দশম দৃশ্য

(পরদিন বিভিন্ন দিক থেকে বাবাসাহেবের কাছে আসতে শুরু করে অত্যাচার ও নিপীড়নের সংবাদ )

আগত ব্যক্তি (জীর্ণ পোশাকে) : বাবাসাহেব আমাদেরকে বাঁচান ওরা আমাদের সব জ্বালিয়ে দিয়েছে । বর্ণবাদীরা আমাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দিয়েছে ( কান্না ) । ওরা বলছে আপনি গান্ধীজীর দাবি না মানলে আমাদেরকে প্রাণে মেরে ফেলবে । (কান্না)

বাবাসাহেব : ( মাথা ঝুঁকিয়ে ,চোখের কোনে জল মোছেন । আত্মকথন) আমি আজ অসহায় ও নিরুপায় হয়ে গেলাম । তোমার মত লাখ লাখ আমার ভাইবোনেরা আর্তনাদে নিদ্রাহীন রাত কাটায় । তুমি ফিরে যাও আমি কালকেই সিদ্ধান্ত নেব ।

আগত ব্যক্তি : জয় ভীম । (চোখের জল মুছতে মুছতে প্রস্থান)

(কিছুক্ষণ পর বাবাসাহেব চোখের জল মুছতে মুছতে প্রস্থান করলেন)

(ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘোষিত হবে ২৪শে সেপ্টেম্বর গান্ধীজি অনশনে অটল রয়েছেন)

(মঞ্চে গান্ধীজি প্রবেশ করে বিছানায় শুয়ে পড়েন ও দুর্বলের অভিনয় করেন । কিছুক্ষণ পর কয়েকজনের সাথে মদনমোহন মালব্যের প্রবেশ ।)

মদনমোহন মালব্য : মহাত্মাজী আপনি চিন্তা করবেন না । আমরা আপনার কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি একটা নিরাপদ চুক্তি করে বাবাসাহেবকে আমরা চাপ সৃষ্টি করব । ইতিমধ্যে চারিদিক থেকে আমাদের নেতারা ডক্টর আম্বেদকরের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছেন ।

গান্ধীজী : ( খুব ধীরে ধীরে উঠে বসলেন অসুস্থ এর ভান করে) বেশ, যেন তাই হয় । তবেই আমি বেঁচে উঠতে পারব ।

(বাবাসাহেব প্রবেশ করেন )

গান্ধীজী : ডঃ আম্বেদকর , আপনাকে ধন্যবাদ আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য । আপনি জন্মসূত্রে অস্পৃশ্য । আর আমি স্বেচ্ছায় অস্পৃশ্য । আসুন দুজনে মিলে এই হিন্দু সমাজের বিভেদ দূর করি । আপনি পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবি প্রত্যাহার করুন । পরিবর্তে প্রাদেশিক আইন সভায় Depressed classes এর জন্য ১৪৮ টি আসন এবং কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে হিন্দুদের আসনের দশ শতাংশ আসন ছেড়ে দেওয়া হবে ।

বাবাসাহেব : আমি জানি যে এই চুক্তির ফলে আমার সমাজ বঞ্চিত হবে । কিন্তু আমি নিরুপায় । তাই চুক্তির শর্ত মেনে নিতে আমি বাধ্য হলাম ।

মদনমোহন মালব্য : (ফাইল থেকে কাগজ বাইর করে বাবাসাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন) ডঃ আম্বেদকর ।

বাবাসাহেব : (হাত বাড়িয়ে নিয়ে সই করে ক্ষোভে পেনের নিব ভেঙ্গে ছুরে দিলেন)

মদনমোহন মালব্য : (পুনরায় কাগজটি নিয়ে সই করলেন এবং উপস্থিত সকলেই সই করলেন )

   (সকলেই প্রস্থান)

( background ঘোষণা : এভাবেই বাবাসাহেব একা কাঁধে লড়ে গেছেন অস্পৃশ্য সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ।)

                                        -সমাপ্তি