click on images to know more about the Images
(দূর থেকে বাতাসের শব্দ এসে হঠাৎ থেমে যায় )
কৃষ্ণঃ- (ধাক্কা খেয়ে) কে রে ?
রামঃ- (থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি) আমি ভাই, আমি।
কৃষ্ণঃ- অন্ধ নাকি ? এমন করে কেউ ধাক্কা মারে ?
রামঃ- কিছু মনে করোনা। চারদিকে আবছা অন্ধকার, তোমার গায়ের রঙটাও কালো। তাই ঠিক বুঝতে পারিনি। অবশ্য আমিও কালো। আচ্ছা, তুমি কে ভাই ?
কৃষ্ণঃ- আমি আবার কে ! আমি অতীত ।
রামঃ- আমিও তো অতীত।
কৃষ্ণঃ- ওটা কি আর বুঝতে বাকি থাকে! অতীত নাহলে এই মহাশূন্যে কেউ শখ করে উড়ে বেড়ায়! নিশ্চয়ই পৃথিবীর জন সমুদ্রে চলাফেরা করে বেড়াতাম।
রামঃ- তা যা বলেছো। আচ্ছা পৃথিবীর কোন দেশে তোমার বাড়ি ছিলো ?
কৃষ্ণঃ- আমার ছিলো ভারতবর্ষের মথুরা নগরে। তুমি কোন দেশের ?
রামঃ- আমিওতো ভারতবর্ষের ।
কৃষ্ণঃ- (আন্তরিক হয়ে) তাই নাকি ? ভারতবর্ষের কোথায় গো ?
রামঃ- ওই তো, যেখানে মন্দির মসজিদের গণ্ডগোল হয়, সেই অযোধ্যায়।
কৃষ্ণঃ- বাঃ! খুব ভালো। আমরা তাহলে দেশোয়ালী ভাই। তোমার নাম কি ছিলো ?
রামঃ- নাম বললে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। কৌশল্যা নন্দন রাম।
কৃষ্ণঃ- (উৎফুল্ল হয়ে) হ্যাঁ-হ্যাঁ, নাম শুনেছি। তুমি তো ছিলে অযোধ্যার রাজা।
রামঃ- হ্যাঁ, রাজা তো অবশ্যই। কারণ, আমি যে ক্ষত্রিয় সন্তান।
কৃষ্ণঃ- তবে বহিরাগত । হিমালয় পাহাড় ডিঙিয়ে ভারতে প্রবেশ।
রামঃ- বহিরাগত আমার কোনো পূর্বপুরুষ। আমার জন্ম ওই অযোধ্যায়। তোমার নাম কি ?
কৃষ্ণঃ- আমার নাম নন্দদুলাল কৃষ্ণ।
রামঃ- কৃষ্ণ ! তাহলে তুই তো আমার চেয়ে ছোটো রে ভাই ! আমার অনেক পরে পৃথিবীতে এসেছিস। তুইও তো রাজা হয়ে ছিলিস !
কৃষ্ণঃ- হ্যাঁ। তবে তোমার মতো রাজার ছেলে রাজা, তা নয়। আমি গোয়ালার ছেলে। রাজা ছিল আমার অত্যাচারী মামা কংস। সেই মামাকে হত্যা করে রাজা হয়েছিলাম।
রামঃ- পুরানো কথা এক এক করে সব মনে পড়ছে। তুই খুব ডানপিটে, বদমায়েশ ছিলিস। যুবতীদের পিছনে লেগে খুব অতিষ্ঠ করে তুলতিস।
কৃষ্ণঃ- সত্যি কথা বলতে আজ দ্বিধা নেই। চোরও ছিলাম। চুরি করে কত কিছু খেয়েছিলাম। তুমি তো ছোটো থেকে খুব নিরীহ, গোবেচারা। রাজা হয়েও তাই ছিলে।
রামঃ- একটু ত্যাগ স্বীকার করলে যদি সমস্যা মিটে যায় তো ঝুট ঝামেলায় যাবো কেনো ?
কৃষ্ণঃ- তোমার বুদ্ধি-সুদ্ধি কম ছিলো,তাই হয়তো ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলতে ।
রামঃ- বুদ্ধি কম! কি রকম ?
কৃষ্ণঃ- পুরোহিত, মুনি ঋষিরা যা বলতো, তুমি তাই করতে। তোমাকে যখন তখন তাতিয়ে ওরা নিজেদের কাজ হাসিল করতো।
রামঃ- (চিন্তা করতে করতে) কী বলছিস, আমি তো ঠিক...
কৃষ্ণঃ- মনে পড়ছে না ? তাড়কা বধ, শুদ্ররাজ শম্বুকের শিরশ্ছেদ- এসব করোনি ?
রামঃ- অ । এই কথা বলছিস ? মুনি ঋষিরা নির্জনে তপস্যায় বসলে তাড়কা বার বার এসে ওদের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো। আর শম্বুক তো ধর্মগ্রন্থ অপবিত্র করেছিল। তাই...
কৃষ্ণঃ- ওরা মূলনিবাসী। ওদের এলাকা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তা দেখে রাগ হবে না ? তোমার আরো একটা ভুল, প্রজাদের কথা শুনে তুমি তোমার স্ত্রীকে তাড়িয়েছো।
রামঃ- সবাই জানে আমি প্রজানুরঞ্জন রাজা। দেশের শান্তি বজায় রাখতে গিয়ে ওই কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম রে ভাই।
কৃষ্ণঃ- যা হয়ে গেছে, যাক। ওসব ব্যক্তিগত ঘটনা ঘাঁটাঘাঁটি করে আর লাভ নেই।
রামঃ- হ্যাঁ। ওসব ছেড়ে বর্তমানে আসা যাক। তুই এই দিকে কোনো কাজে যাচ্ছিলিস ?
কৃষ্ণঃ- অতীত হয়ে গেলে আর কাজ থাকে ! এখন শুধু নেই কাজ তো খই ভাজ।
রামঃ- মানে ?
কৃষ্ণঃ- প্রতিদিন ওই ঢিবিতে বসি, আর নিচে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকি ।
রামঃ- তাকিয়ে থাকিস ? কী দেখিস- পৃথিবীর ?
কৃষ্ণঃ- ওই ভারতবর্ষের মানুষদের। একদল মুষ্টিমেয় মানুষ বুদ্ধির জোরে বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কেমন করে শোষণ করছে !
রামঃ- শোষণ করছে ! কারা কাদের শোষণ করছে ?
কৃষ্ণঃ- তুমি মনে হয় পৃথিবীর কোনো খবরই রাখো না।
রামঃ- না রে ভাই। তুই বল, শুনি। যত হোক জন্মভূমির কথা তো, শুনতে মন চায়।
কৃষ্ণঃ-কিছু চতুর মানুষ তোমার আমার নাম ভাঙ্গিয়ে বেশ লুটে পুটে খেয়ে যাচ্ছে।
রামঃ- লুটে পুটে খেয়ে যাচ্ছে ! কারা ?
কৃষ্ণঃ- বহিরাগত গোষ্ঠীর বর্ণশ্রেষ্ঠ যারা।
রামঃ- (অবাক হয়ে) আমাদের গোষ্ঠীর বর্ণশ্রেষ্ঠরা ! কী রকম ?
কৃষ্ণঃ- আমাদের মৃত্যুর পর তোমার আমার জীবন নিয়ে রামায়ণ, মহাভারত লিখেছে এবং প্রচার করেছে- আমরা নাকি সারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা।
রামঃ- সে কি ! সারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ! আমাদের সব কর্মকাণ্ড তো ছিলো এই ভারতবর্ষের মধ্যে ! কেউ প্রশ্ন করে না- এটা সারা বিশ্বের কি করে হয় ?
কৃষ্ণঃ- প্রশ্ন করেনা মানে ! আগের দিনে সাধারণ মানুষের বুদ্ধি কম ছিলো । তাই বিতর্কে না গিয়ে মেনে নিয়েছিলো । এখন বিভিন্ন দিক থেকে হাজারো প্রশ্ন আসছে।
রামঃ- আসবেই তো। ওরা কী উত্তর দিচ্ছে ?
কৃষ্ণঃ- কী উত্তর দেবে ! সঠিক উত্তর নেই ! শুধু ধানাই পানাই করে পাপ-পুণ্য, অভিশাপের ভয় দেখাচ্ছে । কিন্তু এখন কেউ তো ওসবে ভয় পায় না ।
রামঃ- আচ্ছা, এসব করে ওদের কী লাভ ?
কৃষ্ণঃ- লাভ মানে ! লাভে লাভ । বিভিন্ন জায়গায় রামমন্দির, কৃষ্ণমন্দির আরো কত রকম কাল্পনিক দেবদেবীর মন্দির গড়ে পুজোর নামে চুটিয়ে ভণ্ডামি ব্যবসা চালাচ্ছে ।
রামঃ- আচ্ছা আমাদের জন্মের আগে ওদেশে তো পুজো হতো। কাদের পুজো হতো ?
কৃষ্ণঃ- জল মাটি গাছ- এক কথায় প্রকৃতি পুজো হতো। ওরা সেটাকে ধীরে ধীরে নিয়ে গেল কাল্পনিক পুজোয়। লাভের মুখ দেখে লোভের বহর বেড়ে যায়। বিয়ে শ্রাদ্ধের মতো বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানকেও নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়। মানুষের জন্মের আগে থেকে মৃত্যুর পরেও পর্যন্ত শোষণ করতে থাকে।
রামঃ- (চিন্তা করে) তোর কথা শুনতে শুনতে এবার আমার খেয়ালে আসছে- পাড়ায় পাড়ায় আসর বেঁধে ওরা রামলীলা, হরি কীর্তন চালাচ্ছে। মানুষ শুনতে না চাইলেও তবু জোর করে শোনাচ্ছে। উচ্চগ্রামে মাইক চালিয়ে কানের ভিতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
কৃষ্ণঃ- জানি তো। ওরা অসুস্থ, বয়স্কদের কথাও ভাবে না। ওদিকে হরেক দূষণে পৃথিবী হচ্ছে নাজেহাল। ধরে নিলাম আমরা ঈশ্বর, ভগবান। আসার সময় কী বলে এসেছিলাম যে তোরা আমাদের মাহাত্ম্য প্রচার করে রোজগার কর ?
রামঃ- যতদিন রাজা ছিলাম, ততদিন শুধু আদেশ নির্দেশ চালিয়ে এসেছি। এসব কথা বলার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কৃষ্ণঃ- ওরা যত আখের গোছাচ্ছে, তত মূলনিবাসীরা নিঃস্ব হয়ে আমাদের প্রতি বিরূপ হচ্ছে। আমরাও ধান্ধাবাজদের জন্য অকারণে বদনাম কুড়াচ্ছি ।
রামঃ- কৃষ্ণ। এ অনাচার চলতে দেওয়া যায় না ভাই। চল পৃথিবীতে গিয়ে ওই পরজীবীদের নিরস্ত করতে অদৃশ্য থেকে সাবধান করে আসি।
কৃষ্ণঃ- যেতে তো মন চায়, কিন্তু ভাগাড়ে গরু মরলে শেয়াল, শকুন, কুকুরদের যে দশা দেখা যায়, ওরাও ঐরকম মহাভোজে মেতে উঠেছে। আমাদের বারণ শুনবে কেনো ?
রামঃ- আমাদের ঈশ্বর, ভগবান বানাচ্ছে আর শুনবে না মানে ?
কৃষ্ণঃ- কেউ চায়- তার বাড়া ভাতে ছাই পড়ুক ?
রামঃ- তা ঠিক ।
কৃষ্ণঃ- মানুষকে ঠকালেও ওরা ভালোই জানে ভূত মানে অতীত। ভয়ের কিছু নয়। তাই আমরা রাম কৃষ্ণের অতীতে এসেছি- এ কথা তো মানবেই না। মুখে ওরা যত ধর্ম ধর্ম, ভগবান ভগবান বলুক, স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছুতেই যেতে চাইবে না।
রামঃ- যতদিন রাজা ছিলাম, ততদিন এসে গড়াগড়ি খেয়েছে। এখন অতীত হয়েছি, আমাদের আর কোন মূল্য নেই। তাহলে ভাই এখন কি করা যায় ?
কৃষ্ণঃ- কিচ্ছু করার নেই। যা হচ্ছে হোক। আমরা এখন থেকে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে দেখতে থাকি আর যতদিন না দিন বদলাচ্ছে ততদিন সহ্য করে যেতে থাকি।
------ শেষ ------