click on images to know more about the Images
ছোটো গল্প
: কিষাণের বেটা সুজিত :
কলমে - নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল
শিব নগর, রমনা, ফুতকি পাড়া, শ্রীহরিপুর, ডোয়া পাড়া, এই পাঁচ পাড়ার গিরস্ত ধরণী মড়ল। ছোটো খাটো জোতদারও বলা যায়। একটি গম মাড়াই করা যন্ত্র নিয়ে এসেছে ধরণী মড়ল। নাম তার হপার। এই পাঁচটি গ্রামের বেশিরভাগ চাঁই জন জাতির বাস । আগে পাম্প সেটের সঙ্গে থ্রেসার সেট করে গম মাড়াই করা হতো। তাতে বহু ঝামেলাতো ছিলই , ছিল তাতে বহু প্রতিবন্ধকতা অসবিধা এবং শ্রম শ্রাদ্ধও বটে। তার থেকেও উন্নত প্রযুক্তির গম মাড়াই হপার যন্ত্রটি । অজ পাড়া গ্রামের মানুষ তাই দেখতে ভিড় জমাচ্ছে কয়েক দিন ধরেই। প্রথম গাছা গম মাড়াই শুরু হবে এই মাত্রই। গ্রামের অতিসাহিত কিষাণ পুত্র সুজিত মণ্ডল। দেখছে অনেকেই আছে কিন্তু হপারে গাছা গমগাছ গুলি ধরার সাহস করছেনা কেউ। গোবর গাড়হার একটি লেবার আসার কথা ছিল সেও আসেনি। যন্ত্রটির কাজ দেখার জন্য কারো ধৈর্য আর ধরে না কিন্তু যন্ত্রটিতে গাছা গম ধরার জন্য এগিয়ে আসার সাহসও কারো নেই । গ্রামের ডাকা বুকা সুজিত ছেলে তার কাছে ফিছুপা হওয়ার কাজ কমিই আছে । যেনো লোহাকেও একটু কামড়ে দেখে চিবানো যায় কি না। সবার ভিড় ঠেলে দুহাতে ভিড় ফেড়ে এগিয়ে যায় আমিই ধরব গমের আটি বলে। এই ছেলেটা ডাকাবুকা হলেও লোকের কাছে পুচকে ছেলে সব কিছুতেই এই পুচকে ছেলেটার বাহাদুরি আর ওস্তাদি। যেই যাই বলুক হপার স্টার্ট দিয়ে এই তরুণ বালক গাছা গম ধরা শুরু করে দিল। খর খর হড়মড় করে থাকা হপারের নিচে নিকটে গম একটু দূরে ভুসি পড়তে লেগে গেল। খুবই মজার ব্যাপারতো সকলেই আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগল। কয়েকজন উৎসাহি সুজিতের দেখাদেখি হপারের কাছে গম ধরার জন্য হুড়াহুড়ি লাগিয়ে দিল। কিছু ভালো মন্দ না বুঝেই গাছা গম ধরা মুখ থেকে সুজিত হাত না বার করার আগেই এক আটি গাছা গম এক জন হঠাৎ করে কে যেনো ঠুসে ভরে দিল আর সুজিতের হাত আটকে গেল। সেই আটি গাছা গম মাড়াই হতে একটু ছিলই । তার সঙ্গে অমনি নরম গমের গাছের সঙ্গে সুজিতের হাত জড়িয়ে গিয়ে হপারের গমের গাছ কুচি করার হলারের হুকে আটকে গিয়ে হ্যাচকা হাতের কুনই এর উপরের অংশ থেকে কেটে নিল। হায় একি হল! ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে হপার রক্তের রং এ রঙ্গিয়ে গেল। বড় সর্বনাশ হয়ে গেল। পরশ্রী কাতরদের কেউ কেউ বড় কুটোক্তি করে বলল যে, " লে না এবার সুখটা মিটেছেতো, যেমন সব কাজে বাহাদুরি ? " সঙ্গে সঙ্গে বহরম পুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল কিন্তু কাটা হাতটা কোনো ভাবেই জোড়া লাগানো গেল না । আত্মীয় স্বজন শোকে শোকাচ্ছন্ন হয়ে গেল। গ্রামের বেশির্ভাগ মানুষ বলল, "হাই কি হল।" সোজা বুদ্ধির মানুষেরা বলতে থাকল দূর ছাই ঐ রাক্ষসে গম মাড়ার যন্ত্রটা দেশে না এলে ছুড়াটার এই ভাবে বেঘরে ওতো সুন্দর হাতটা খোয়াতো না।
একটা হাত কেটে গেলেও সুজিত এতটুকু দলে যায়নি বা হতাশাই ভেঙ্গেও পড়েনি। তবে মনে মনে যে কষ্ট পাচ্ছে তা বলা যাবে না। তবে হ্যাঁ এই ঘটনায় সুজিতের কৃষি বিদ্যা অর্জনে তার মনের জোর ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা অদম্য হয়ে উঠল। যাইহোক বিজ্ঞান বিভাগে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করল। সুজিতের জীবনে প্রতিজ্ঞা কৃষি যন্ত্রে যখন হাত খুয়েছি তখন আমি একটা কৃষি বিজ্ঞানী হতেই হবে । এ একটা জীবনে জেদ এবং প্রতিজ্ঞাও বটে। এগ্রীকালচার নিয়ে বি এস সি পড়ার সময় সুজিতের ফেসবুক পেজে একটি ষোড়শী যুবতি ফলো করত। সুজিতের কৃষি বিষয়ে বিভিন্ন পোষ্টে লাইক কমেন্টস করতে লাগল। ফেসবুকে পরিচয় হলেও তাদের প্রেম ভালোবাসা অনেক গভীরে চলে গেল। দুই জনেই বসে যেত আধুনিক জগতের সেল ফোনের বিভিন্ন হোটস আপ ম্যাসেঞ্জার ফেসবুকে চ্যাটিং করত স্কুল কলেজের অবসর সময়ে। এটা প্রায় চরম পর্যায় পৌঁছে গেল। তাদের মধ্যে একটা পূর্ব রাগের সৃষ্টিও হয়ে গেল। যদিও সুজিতের এই প্রেম ভালোবাসার খেলাই একটু অনিহাও ছিল । কেনো সুজিতের অনিহা ও মনের প্রতি দুর্বলতা ছিল তা পাঠক মাত্র একটু আধটু অনুমান নিশ্চিত করতে পারবেন । এক দিন তাদের মধ্যে দেখাও হল। দেখার পর থেকেই যেনো ভালোবাসার দূরত্ব হতে লাগল। কিন্তু চ্যাটিং এ সেটা বোঝা না গেলেও সুজিতের কোথাও যেনো একটা মনেহল এ প্রেম ভালোবাসা আমার জন্য নয়। প্রেম ভালোবাসা যেনো কেড়ে নিয়েছে সেই আধুনিক কৃষি যন্ত্র হপারটি । এর পর তার মনের ভীতর আপসোস আবেগ হলেও পড়াশোনা পুস্তক সাধনার কাজে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়ল না। মনের জোর আর উদ্দম, দিন দিন বেড়েই চলল। এগ্রীকালচারে স্নাতক হওয়ার পর পরেই একটি কৃষি গবেষণায় কৃষকদের সহায়তার একটি চাকুরিই বলা যায় জুটে গেল। কিন্তু সুজিতের মধ্যে এগ্রিকালচারে অগাধ জ্ঞানের সমাবেশ ঘটে ছিল তা বলায় যায় । এখানে থেমে থাকলে চলবে না। সুজিত ফার্স্ট লার্নার ছাত্র। উপরে মামা কাকা নেই যে তাকে কেউ একটু সহায়তা সাহায্য সুযোগ করে দেয়। এক কথায় ভারত বা পশ্চিমবঙ্গে ধান্য কবেষণার সুযোগ হল না। দেশ তার ধান্য গবেষণার জ্ঞান ভান্ডারের মর্যদা দিল না। সুজিত নিজস্ব ফার্ম ল্যাবরেটরি কিছুই নেই। কি করে করবে তেমন কিছু ভেবে ঠিক করে উঠতে পারে না। কিন্তু এতে হতাশ হয়ে ভেঙ্গেও পড়ল না। তবে মনের চিন্তা যে বাড়ল না তা বলা যায় না। কিছু দিন কেটে যায় । এমন সময় একদিন একটি আন্তর্জাতিক এগ্রীকালচার কর্মক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ায় একজন ধান্য গবেষক ছাত্র চায় বলে একটি অ্যাড দেখতে পায় । বিদেশ বিভূই সেখানে গিয়ে কি টিকতে পারবে ? কিন্তু এখানে একটা সামান্য কৃষি সহায়ক হয়ে থেমে থাকলেই কি হবে! প্রথমে নিজে ঠিক করল যে সে ঐ ইন্দোনেশিয়াতেই যাবে। সমস্ত যোগ্যতার প্রমাণ পত্র দিয়ে আবেদন করে ইন্দোনেশিয়ায় ইমেল করে পাঠিয়ে দিল। প্রথমত পিতা মাতা কোনো ভাবেই রাজি হতে চায়না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করা হল। ইন্দোনেশিয়া কৃষি বিজ্ঞান বিভাগ তা খতিয়ে দেখে সুজিত ধান্য গবেষণার জন্য মনোনীত করে ফেলল এবং অতি সত্তর যোগ দানের জন্য মেল চলে এলো। মেল অনুসারে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে সুজিত তারিখ অনোসারে একদিন ইন্দোনেশিয়া পাড়ি দিল। বিস্তৃর্ণ জায়গা জুড়ে ফার্ম। বিশাল জায়গা জুড়ে ল্যাব্রেটরি। সব দেখে মনে হল সত্যই এই না হল গবেষণার ক্ষেত্র বটে। কাজে যোগ দিল। ফার্ম পরিদর্শণ করে দেখল প্রায় দু হাজার প্রজাতিরও বেশি ধানের প্রজাতি আছে । ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীতে এমনিতেই ধান্য উৎপাদনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্থানেই ছিল। সুজিত যেনো মনে হল ধান্য গবেষণার ক্ষেত্রের পরিকাঠামো দেখে, ধান্য গবেষণার এক স্বর্গ হাতে পাওয়া গেল। সুজিত প্রাণপণে নিজের মনপ্রাণকে গবেষণায় উজাড় করে দিয়ে দিল। কয়েকটি প্রজাতির ধানও আবিষ্কার করে ফেলল । যা রীতিমতো অবাক করার মতো। যার ফলন হবে বেশি, খুব কম জলসেচে এবং বছরের যেকোন মরশুমে। যার গড় ফলন দাড়াল একরে আটচল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কুইন্টাল। পৃথিবীতে ইন্দোনেশিয়ার এই সাফল্যে হৈ চৈ ফেল দিল। ভারত হল পৃথিবীর জন সংখ্যাই দ্বিতীয় সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ। প্রায় এক শত চল্লিশ কোটি জন সংখ্যার দেশ। এই দেশে বছরে প্রচুর চালের দরকার হয়। অথচ এই ভারত ভূমের ধান উৎপাদনের ধান্য জমি গুলি প্রাকৃতিক বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল। কোনো বছর খরাই ধান গাছ পুড়ে শেষ হয় নাতো বন্যায় ডুবে শেষ হয় । তাই খরার সময় বিদ্যুত ডিজেলের যা অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি তাতে কম জল সেচের ধান উৎপাদনের গবেষণার খুব প্রয়োজন। তাই ভারতের ধান্য উৎপাদনের জন্য এক উচ্চ পর্যায়ের গবেষণার আসু প্রয়োজন। ভারত সরকার দেশকে খাদ্যেে সাবলম্বি করার জন্য ধান্য গবেষণার এক উচ্চ পর্যায়ের ধান্য গবেষণার প্রয়োজন উপলব্দি করেন। ভারত এক সময় এই প্রয়োজনের কথা ভেবে ইন্দোনেশিয়া সরকারকে ধান্য গবেষণার এক সেমিনারে যোগ দেওয়ার আহ্বান করেন। তা এই আহ্বানে ইন্দোনেশিয়া সাড়া দেয় এবং এই সেমিনারে সুজিতকে ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধি নির্বাচন করে। ভারতে এসে সুজিতের কম জল সেচে অসাধারণ সব ধান্য উৎপাদনের সফল গবেষণা গুলি দেখে আশ্চর্য হয় এবং খোঁজ খবর নিয়ে দেখে এই অসাধারন ধান্য ও গমের সফল গবেষক আসলে ভারতেরই কিন্তু তাকে ভারতে গবেষণার বা মর্যদা দেওয়া হয়নি । যে কিনা এক সময় ভারতে অর্থের অভাবে গবেষণার সুযোগ পায়নি। এই সংবাদ ভারতের সব কাগজে হেড লাইন করে ছাপানো হল। এই সংবাদ সুজিতকে এক সময় ভালো বেসেছিল সেই সবিতা জানতে পারে, যে সুজিতের ভারতেই জন্ম সেই সুজিত আজ কম জলসেচে ধান্য উৎপাদনের একজন দিকপাল সফল গবেষক হিসাবে গোটা পৃথিবীতে একটা বিশেষ সাড়া ফেলে দিয়েছে। সুজিত ভারতে গবেষণা করতে পেলে তার আবিষ্কারের পেটেন্ট গুলি ভারত অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রি করে কোটি কোটি স্বর্ণ মুদ্রা ঘরে আনতে পারত কিন্তু সুজিত ভারতে গবেষণার সুযোগ পায়নি বলে আজ সুজিতেরই আবিষ্কার করা কম জলসেচের কয়েকটি জাতের ধানের পেটেন্ট কোটি কোটি স্বর্ণ মুদ্রা ইন্দোনেশিয়া সরকারকে দিয়ে কিনে নিতে হল ভারতকে । এই দিকে সবিতা সুজিতকে দেখার জন্য ও জীবন সঙ্গি করার জন্য পাগলপরা হয়ে উঠল। যে কিনা একদিন হাতের কাছেই মজুত ছিল। সুজিতের কাছে এখন কোন লজ্জায় দেখা করবে। কি তাই বলে সুজিতের হৃদয় মনে কোনো অহংকার বা অহং বোধ ছিল না কোনো দিনও আজও নেই। ভারতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই একটি ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়ে ছিল । সবিতা সাত পাঁচ ভেবে সুজিতের সঙ্গে দেখা করার জন্য উতগ্রীব হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। বিমান বন্দরে শয়ে শয়ে সাংবাদিকের ভীড় উপেক্ষা করে গিয়ে দেখল যে সবিতাকে আশাহত করে সবিতার বুকে একটা চরম মোচড় দিয়ে সুজিতের ফ্লাইটি তখন আকাশের অনেক উপরে উড়ছে।
সমাপ্ত।
বিঃদ্রঃ গল্পটির কপি নকল বা যে কোনো রকমের নকল স্কিন সট অনুবাদ নিষিদ্ধ।