click on images to know more about the Images
বহুজন শব্দের সাথে অনেকেই অল্প বিস্তর ধারাণা পোষণ করে থাকেন। আর এটাও জানেন যে বহুজন মানেই সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষের কথা বলা হচ্ছে। তবে এই ধারণা কখনই জন্মায়না যে বহু বা বেশী অর্থাৎ শক্তি, বহুজন অর্থাৎ বেশী মানুষ মানে বেশী শক্তি। ভারতে যারা বহুজন সম্প্রদায় ভুক্ত তারা কিছুতেই অনুভব করতে পারেনা যে তারা শক্তিশালী। এ বিষয়টি যুক্তি সাপেক্ষ আর সংবেদনশীলও বটে। এটি এখানে আলোচ্য বিষয়ে নয়। তবে এই পরিপ্রেক্ষিতে বলে রাখা দরকার যে শব্দের ধারাণা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যি সত্যি বহুজন হওয়ার জন্য উদ্যম তো হয়েছে হচ্ছে আর ভবিষ্যতেও হবে, এই বহুজন হওয়ার উপক্রমে এই শব্দের উৎপত্তি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। বহুজন শব্দটির সাথে তথাগত বুদ্ধের যোগসূত্র রয়েছে সেই ধারণাও সমাজে রয়েছে বলা বাহুল্য হবে না। “বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়” কথাটি বুদ্ধের উপদেশের একটি সুত্ত, যা ত্রিপিটকের বিনয় পিটক থেকে গৃহিত হয়েছে অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতেই এই শব্দের উৎপত্তি। কিন্তু বুদ্ধ ধম্ম ভারত থেকে লোপ পাওয়ার পর বুদ্ধের নীতি আদর্শ সবই লোপ পেয়ে যায় ভারতের বহুজন সমাজের কাছ থেকে।
আধূনিক যুগে অনেকের ধারণা বহুজন শব্দটি কাঁসিরামজীর খোঁজ, বহুজন সমাজ পার্টির মাধ্যমে। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। আজ থেকে একশত বছর আগে ১৯২০ খৃষ্টাব্দে মহারাষ্ট্রের বিটঠল রামজী শিন্দে একটি রাজনৈতিক সংস্থা স্থাপন করেন ও নাম দেন “বহুজন পক্ষ” মারাঠীতে পক্ষ মানে পার্টি। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত সত্যশোধক দিনকররাও জাভলেকরের বহুবিতর্কিত “দেশাচি দুশমন” বইতে বহুজন শব্দটি বহুল ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মূল মারাঠী শব্দটি হিন্দিতেও একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর বাংলা ভাষাতেও এর বিকল্প শব্দ খোঁজার প্রয়োজন হয়নি, তপশিলি জাতি, উপজাতি অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি ও ধার্মিক সংখ্যালঘুদের সমষ্টির নাম হচ্ছে বহুজন। তপশিলি জাতি ও উপজাতির সমষ্টিগত নাম হচ্ছে ‘দলিত’ যদিও শব্দটি অসংবৈধানিক এবং বাবাসাহেব আম্বেদকর কখনও এই শব্দটি ব্যবহার করেননি তা সত্ত্বেও এই শব্দটি থেকে মুক্ত হওয়া যায়নি।
দলিত শব্দের সাথে তার সাহিত্য চর্চাকেও দলিত সাহিত্য নামেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। মারাঠী, হিন্দি ও ভারতের বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর দলিত সাহিত্য রয়েছে তার সাথে বাংলাতেও এই দলিত সাহিত্যের রমরমা কম নয়। দলিত সাহিত্যের বিরাট বড় পৃষ্ঠভূমি রয়েছে, এই বাহুল্যতার পেছনে বাবাসাহেব, ফুলে, পেরিয়ার, কবির রবিদাস ইত্যাদি মহাপুরুষের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁরা নিজেরা দলিত মুক্তির আন্দোলনের সাথে সাথে সাহিত্যও রচনা করে গেছেন। তাই দলিত সাহিত্যের মত বহুজন সাহিত্য বাহুল্যতা লাভ করেনি বাংলা ভাষায় তো মোটেই তা হয়নি বলা যেতে পারে। যদিও হিন্দি ভাষায় বহুজন সাহিত্যের আবির্ভাব হয়েছে অনেক আগেই এবং এই সাহিত্যের ইতিহাসও সমৃদ্ধশালী ইতিহাস। চার্বাক, বুদ্ধ, ও সন্ত পরম্পরার সন্তগণ পর্যাপ্ত পরিমাণে সাহিত্য রচনা করেছেন। সন্ত নামদেব, সন্ত গাডগে মহারাজ, সন্ত চোখাবা, সন্ত তুকারাম এনারা বহুজন সাহিত্যের মৌলিক কাজগুলো করেগেছেন।
হিন্দি ভাষায় ফরওয়ার্ডপ্রেস নামক সুংস্থা ও এর লেখক সম্পাদক ও চিন্তাবিদরা যেমন, আয়বান কোস্কা, রাজেন্দ্র প্রসাদ সিং, প্রেম কুমার মণি, প্রমোদ রঞ্জন প্রমুখ বহুজন সাহিত্যের পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা স্থাপনের জন্য প্রচুর কাজ করে চলেছেন। কারণ সন্তগণের দ্বারা যে সাহিত্য সম্ভার রচিত হয়েছে তা আধুনিক যুগে যথার্থ ভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না। তাই হিন্দি ভাষায় এই সাহিত্য নিয়ে ফরওয়ার্ডপ্রেস যেমন ভাবে চিন্তা করছে তা হল, এই সাহিত্যে দলিত, আদিবাসী, এবং মহিলা ছাড়াও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) সাহিত্যও সমাবিষ্ট হওয়া দরকার যার জন্য ওবিসি সাহিত্যের পৃথক পারিচয় কি হতে পারে বা তার সাংকেতিক পারিচয় কি হতে পারে তা নিয়ে গভীর চিন্তন দরকার। এটা বেশ কঠিণ কাজ কারণ যদিও প্রচুর ওবিসি লেখকের রচনা সম্ভার রয়েছে তা এখানে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয় কারণ সেখানে তাদেরই জীবনের কাহানী লেখা আছে যা স্পষ্টরূপে বহুজন সাহিত্য হিসাবে চিহ্নিত করা যায়না। আর সবর্ণদের দ্বারা এদের জন্য যা রচিত হয়েছে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ নয় কারণ সেগুলো এই ধারণাকে নজরে রেখে লেখা হয়নি। বাংলাতেও প্রচুর লেখক লেখিকা রয়েছেন যাঁরা বহুজনদের উপর লিখেছেন কিন্তু তাঁদের লেখাও কি বহুজন সাহিত্য নামে নামিত করা যেতে পারে? এখানে বলার তাতপর্য হচ্ছে দলিত সাহিত্য যেরকম দলিতদের নিয়ে তাদের আন্দোলনকে নিয়ে তাদের উত্থান-পতন ও তাদের শোষন শাসন ও নির্যতনা কে নিয়ে এক যুক্তি সঙ্গত ও বিজ্ঞন মনস্কতা নিয়ে রচিত হয় তেমন বহুজন সাহিত্যও হওয়া দরকার। বহুজন সাহিত্যের বদ্ধ ধারণা বুদ্ধ, কবির, রবিদাস, ফুলে পেরিয়ার আম্বেদকর হরিগুরুচাঁদ এবং ভগত সিংএর থেকে আসা দরকার। বৈদিক, পৌরাণিক এবং ব্রাহ্মণবাদী দর্শণ বাদ দিয়ে বুদ্ধের দর্শন যা বিজ্ঞান ও যুক্তি সম্মত তেমনই হওয়া দরকার।
কঁওল ভারতীর মতামত হল যে দলিত সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে সত্যতা রয়েছে যে দলিতদের যে ভাবে মানসিক আর শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তারই ফলস্বরূপ দলিতদের আন্দোলন ব্যপক ও প্রভাবশালী হয়েছে। আর তাদের সাহিত্যও যথেষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছে কিন্তু বহুজনদের ক্ষেত্রে এরকম কোন সামঞ্জস্য দেখা যায়না যদ্যপি এটা সত্য যে উচ্চ জাতের মানুষেরা এদেরকে কখনও নিজেদের সমকক্ষ মনে করেনি বা এদের কঠিণ পরিশ্রম বা অনবরত সেবার জন্য তাদের প্রতি কখনও কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করেনি।
প্রেম কুমার মণির মতে আজ ওবিসি সাহিত্যের উত্থান না হওয়ার পেছনে দলিত সাহিত্যের সংকীর্ণমানসিকতাও কিছু অংশে দায়ী।
বহুজন সাহিত্য কেন দরকার? সাহিত্য মানে শিক্ষা, সাহিত্য মানে চেতনা, সাহিত্য মানে ভাবনার পরিপ্রকাশ, সাহিত্য মানে আন্দোলন। হ্যাঁ সাহিত্য দ্বারাই আন্দোলন গড়ে ওঠে। বহুজন সাহিত্যের আদর্শগত ধারণার আধারে বহুজন সমাজ তৈরি হওয়া দরকার। ভারতে মুষ্টিমেয় সংখ্যার মনুর সন্তান আর্য ব্রহ্মনরা যুগ যুগ ধরে শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতনা, বঞ্চনা ও ঘৃন্য জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য করেছে যে সাহিত্যের মাধ্যমে সেগুলো হচ্ছে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ ও মনুস্মৃতি। দেশের অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত ও কু শিক্ষিত সরল নিরিহ মানুষকে ভাগ্য, ভগবান, ইহলোক-পরলোক ইত্যাদি অদৃষ্য আতঙ্ক সৃষ্টি দ্বারা বস করে আজও গোলাম বানিয়ে রেখেছে তারা। যে বহুজন সমাজ তাদের গোলামগিরি করে চলেছে তাদের একটি বৃহৎ অংশ হচ্ছে ওবিসি সমাজ। এই ওবিসি সমাজই বহুলাংশে বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছে সমাজে। তাদের মধ্যে আত্মচেতনা বোধ সঠিক ভাবে জাগ্রত করার জন্য এবং মনুবাদী অবান্তর ও গোলামগিরি উদ্রেক করা সাহিত্যের বিরুদ্ধে বাস্তব বিজ্ঞানমনষ্ক বহুজন সাহিত্য নির্মান হওয়া দরকার যেখানে দলিত সাহিত্যকার যারা আছেন তাঁরা সঙ্কির্নতা ত্যাগ করে বহুজন সাহিত্যে প্রস্তুত করা দরকার। এই মহৎ প্রচেষ্টার ফলেই আসল বহুজন একতা তৈরী হওয়া সম্ভব, আর সেই শক্তি নিয়েই সমাজে সাম্য, মৈত্রী ও করুণা প্রতিষ্ঠা করে ভেদাভেদ বিহীন প্রত্যেক ব্যক্তির আত্মসম্মান যুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব ।