click on images to know more about the Images
লিপিকা আচমকা ফোর্থ হয়ে যাবে তা তার মা-বাবা বিশ্বাসই করতে পারছে না। আর করবেই বা কেমন করে! বরাবর সে ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে আসছে। এমন কী সেকেন্ড বা থার্ড পজিশনে যারা থাকে, তারা লিপিকার চেয়ে কম করে হলেও একশো নম্বর কম পায়। সেই লিপিকা কিনা হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষার চেয়ে একশো সাতাশ নম্বর কম পেলো! কিছুতেই হিসাব মিলছে না কারো।
লিপিকার বাবা, সঞ্জীব, প্রথমেই প্রাইভেট টিউটরদের কাছে গিয়ে মেয়ের পড়াশুনার বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়। না, টিউশনির পড়াশুনা যথেষ্টই ভালো ভাবে করে লিপিকা। এমন কী টিউশনির মান্থলি এক্সামগুলোতেও খুব ভাল করে সে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায় হলো! মেয়ের স্কুলে গিয়েও একদিন খোঁজ খবর নেবে সঞ্জীব।
গ্রামের স্কুল। বার্ষিক পরীক্ষার খাতা ছাত্র-ছাত্রীদের দেখানো হয় না। স্কুলে গিয়ে জানলো, লিপিকার বিষয়টা নিয়ে স্যার ম্যাডামদের মধ্যেও যথেষ্ট চর্চা হয়েছে। সে নাকি প্রতিটি বিষয়ের উত্তরপত্রেই কুড়ি থেকে পঁচিশ নম্বরের উত্তর লিখতে পারেনি!
তার মানে সে কি উত্তর লিখে কমপ্লিট করতে পারেনি! নাকি সত্যিই তার প্রস্তুতির ঘাটতি ছিলো! কিন্তু তার জন্য সব বিষয়েই একই অবস্থা হবে! কিছুই বুঝতে পারছে না সঞ্জীব, কেন এই অঘটন।
একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটে সঞ্জীব ও লাবণ্যর।
একদিন সঞ্জীব লিপিকার এই অঘটনের কারণ উন্মোচনের চেষ্টা করলো কিন্তু অনেক পীড়াপীড়ি করেও মেয়ের মুখ খোলাতে পারলো না সে। বদলে কেবল কেঁদেই চললো মেয়ে।
কয়েক দিন পরে একদিন ভোরবেলা বিছানায় শুয়ে লিপিকা তার মাকে বললো, --‘মা, একটা বিষয় লক্ষ্য করেছো?’
--‘কী বল তো?’
--‘কয়েকদিন ধরে দেখছি, জ্যেঠিমা আমার সঙ্গে খুব ভালো ভাবে কথা বলছে। অথচ আগে যেন কেমন সহ্যই করতে পারতো না!’
--‘হ্যা, রে তুই ঠিকই বলেছিস! আমার সঙ্গেও তো এখন খুব ভালো আচরণ করছে!’ বললো লাবণ্য।
--‘তুমি খেয়াল করে দেখেছো? জ্যেঠিমা বাবার সঙ্গেও আগে তেমন কথা বলতো না। কিন্তু এখন তো সবসময় কথা বলে, মজা করে।’
--‘হ্যাঁ, এখন বাড়ির পরিবেশটা একটু খোলা-মেলা হয়েছে। একই বাড়িতে থেকে সবাই সবার সঙ্গে মন খুলে কথা না বললে কি আর ভালো লাগে?’
--‘হ্যাঁ, তা কত দিন হলো বলতে পারো মা?’
--‘কেন রে? তা বলতে পারিস এক দেড় মাস হয়ে গেলো। ওই তোর রেজাল্ট হলো মনে কর মাস খানেক; একরকম তার পর থেকেই।’
--‘মা, আমি কিন্তু জ্যেঠিমার এই আচরণ পরিবর্তনের কারণটা জানি।’
অবাক হয়ে লাবণ্য বললো, --‘তুই জানিস মানে! কীভাবে?’
--‘জানি, আমার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়েছে তাই!’
মেয়েকে আর কথা বাড়াতে না দিয়ে শায়িত অবস্থাতেই মেয়ের গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দিলো লাবণ্য।
দু জনেই দীর্ঘক্ষণ শুয়ে রইলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। লিপিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে এক সময় থেমে গেলো।
সঞ্জীব ও লাবণ্য কেউ কোনো দিন মেয়ের গায়ে হাত তোলে না। অথচ লিপিকা আজ তার জ্যেঠিমার নামে এমন নীচ ও ঘৃণ্য অভিযোগ আনলো, লাবণ্যকে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তার গায়ে হাত তুলতে হলো।
মেয়েকে মারার পর লাবণ্যর অন্তর দগ্ধ হতে লাগলো। উল্টো দিকে মুখ ঘুরে থাকা মেয়েকে অতি কষ্টে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। লিপিকার থেমে যাওয়া কান্না মায়ের আদর পেয়ে নতুন করে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। চোখের জল মুছিয়ে দরদ ভরা গলায় বললো, --‘মা, জ্যেঠিমা তোমার গুরুজন। তোমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসেন। তিনি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁর নামে এমন গুরুতর অভিযোগ আনা খুবই অন্যায়।’
লিপিকা বললো, --‘মা, আমি অকারণ কোনো কথাই বলিনি! কিংশুকদাদা আমাকে যা বলেছে, তা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।’
কিংশুক, সঞ্জীবের দাদা সঞ্জয়ের একমাত্র ছেলে। লিপিকার চেয়ে ছয় মাসের বড়ো। লিপিকার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। কিংশুক বড়োই সাদাসিধা, পড়াশুনায় লিপিকার চেয়ে বেশ পিছিয়ে। তবে কাকাতুতো বোন লিপিকাকে সে খুব ভালোবাসে।
--‘কী বলেছে কিংশুক?’ জানতে চায় লাবণ্য।
--‘জ্যেঠিমা নাকি একদিন কিংশুক দাদাকে নিয়ে কালীর থানে গিয়ে মানত করে বলেছিলো, যদি আমার রেজাল্ট খারাপ হয় আর কিংশুক দাদার রেজাল্ট আমার চেয়ে ভালো হয় তবে পাঁঠা বলি দিয়ে কালী পুজো দেবেন।
উত্তেজনায় উঠে বসে লাবণ্য। --‘সত্যি বলছিস? কিংশুক তোকে এ কথা বলেছে?’
--‘হ্যাঁ, মা, তুমি চিৎকার কোরো না। জ্যেঠিমা শুনতে পেলে কিংশুক দাদাকে মেরে ফেলবে। পরীক্ষার আগে আগেই নাকি ওকে নিয়ে গিয়ে প্রণাম করিয়ে আর মানত করে আসে।’
দুঃখে, শোকে, যন্ত্রণা ও ঘৃণায় কোনো কথা বলতে পারে না লাবণ্য। কেবল মেয়েকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে নীরবে কাঁদতে থাকে।
দীর্ঘক্ষণ পরে শান্ত হয়ে বললো, --‘কিন্তু তোর এত খারাপ রেজাল্ট হলো কী করে বল তো মা! আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
--‘মা, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমি ইচ্ছা করেই প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখিনি। সবই পারতাম।’
--‘কেন!’ অবাক হয়ে যায় লাবণ্য।
--‘ভাবলাম, দেখিই না আমার রেজাল্ট খারাপ হলে জ্যেঠিমার মনে তার কী প্রভাব পড়ে। এখন তো দেখছি রেজাল্ট খারাপ হয়ে ভালোই হয়েছে। সবার কী সুন্দর মিলে মিশে হাসি মজায় দিন কাটছে। তবে কিংশুক দাদা আমাকে টপকাতে পারলো না, তাহলে জ্যেঠিমার হয়তো আরো ভালো লাগতো।’
লাবণ্যর মুখ কিন্তু থমথম করছে। মেয়ের মুখের কথাগুলো তার কাছে কেমন খাপছাড়া লাগছে।
লিপিকা আবার বললো, --‘আর আমি তো পড়াশুনায় ফাঁকি দিয়ে রেজাল্ট খারাপ করিনি মা! আমি বরং আগের থেকে আরও সেরিয়াসলি পড়াশুনা করছি।’
--‘কিন্তু তোর কেরিয়ারটার কথা একবার ভাবলি না!’
--‘তুমি নিশ্চিত থাকো মা। এই পরীক্ষায় বেশি নম্বর না পেলেও ঠিক সময় মতো আমি কাজের কাজটি করে নেবো। তোমায় কথা দিলাম।’
--‘আর, তুমি এই বিষয় নিয়ে জ্যেঠিমাকে কিছু বলবে না। তাতে কিংশুক দাদা যেমন মার খাবে তেমনি আবার সেই মন কষাকষি শুরু হবে। তার চেয়ে থাক না যেমন চলছে। একদিন হয়তো তিনি নিজেই অনুশোচনা করবেন এবং আমাকে আরও বড়ো হওয়ার জন্য তিনিই উদ্বুদ্ধ করবেন।’
লিপিকার এই কথার পর আর কীই বা বলতে পারে লাবণ্য! সে ভাবলো, --লিপিকা তো ঠিক কথাই বলেছে। এই নিয়ে নাড়া ঘাঁটা করলে আবার তো সেই আগের অশান্তি ফিরে আসবে সংসারে! বরং মেয়ের এই পরিণত ভাবনার জন্য সে পরম শ্লাঘা বোধ করলো। এবং ধীরে ধীরে তার মনও সংযত হলো।
লাবণ্যর মন পরম প্রশান্তিতে ভরে উঠলো এই ভেবে যে, লিপিকা তো আমারই মেয়ে, আমারই রক্ত-অস্থি-মজ্জার পরিণত ফসল।
তার দু-চোখের কোল গড়িয়ে নেমে এলো আনন্দাশ্রু।
---------------