click on images to know more about the Images

আত্মপ্রকাশ

Author: জে. বি. চন্ডাল

ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যাস মালিনীর৷ তার জন্মদিনে যদি কেউ তাকে বই উপহার দিত, সে খুশি হতো সব থেকে বেশি৷ ওর মা বলে, “বালিশির নিচেয় বই রাইহে  ঘুমায় পত্ত আমার মামনি৷ কত রাত্তিরি পত্তি পত্তি  ঘুমায় গেছে ও৷” ওর বাবা এক ধাপ এগিয়ে বলে, “কেউ যদি এক খান নতুন গল্ফের বই দেছে, সেইডে নিয়ে জড়াইয়ে শুয়ে থাকতো৷” দুজনের মুখে এক উজ্জলতা ফুটে ওঠে৷ মালিনীর নৃতত্ত্ববিদ্যার প্রতি উত্সাহ প্রথম যুগিয়েছিল এডওয়ার্ড টেলরের প্রিমিটিভ কালচার বইটি৷ তার আঠেরো বছরের জন্মদিনে বইটি উপহার দিয়েছিল তারই এক অল্পপরিচিত মামা৷ বেথুন কলেজে নৃতত্ত্ববিদ্যায় উচ্চশিক্ষা শুরু করার পরে সেই বিষয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করবে বলে মনস্থির করে৷ স্নাতকোত্তরে ভর্তি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আলিপুর ক্যাম্পাসে৷ সেটা ২০১০ সাল৷  
বিভাগীয় গ্রন্থাগারে অপেক্ষাকৃত কম জনবসতিপূর্ণ এবং বেশি গাঢ় আর পুরু ধুলোর শতাব্দীপ্রাচীন ভৌগলিক মানচিত্রে চুপটি করে প্রায় প্রাচীন অসুর রাজার মত অপরিচিত আর উপেক্ষিত হয়ে বইটি এলিয়ে ছিল অন্যদের গায়ে৷ সম্ভবত মালিনীর নরম, সরু, আর লম্বা আঙ্গুলের আলতো স্পর্শে বেশ একটু নড়েচরে বসেছিল বইটি৷ না কোনো নারী শক্তি-টক্তি নয়, একধরনের ফেমিনিস্ট মর্যাদাবোধ৷ তার গ্রামে সেই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে৷ 
জন্মদিনে বইটি উপহার পাওয়ার পর হয়ত ভালো করে পড়া হয়নি৷ কিন্তু এই বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে এসে জানতে হয়েছে বিস্তর, পড়তেও হয়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত সেই বইটি দেখে তার বেশ কৌতুক জাগলো৷ বইটির কভার পেজ উল্টে দেখে শেষ ১৯৭৯ সালে কেউ বইটি নিয়েছিল গ্রন্থাগার থেকে৷ বইয়ের অধিকাংশ পৃষ্ঠা হলদে আর কালচে হয়ে গেছে; একটু ভাজ পরলেই পৃষ্ঠা ভেঙ্গে যাচ্ছে৷ তাই সাবধানে পাতা উল্টাতে উল্টাতে মুচকি হেসে অস্ফুট স্বরে বলে, “এক শতাব্দীর চেয়ে কম কি!!” 
একবার ক্লাসে নারীর উত্পত্তি বিষয়ে বিতর্কে মালিনী বেশ জোরালো ভাবে বলেছিল, “ইসলাম বা হিন্দু  ধর্মে নারীর উত্পত্তি নিয়ে আলোচনা না করে অনেক বেশি নৃতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন৷ সব সংগঠিত ধর্মমত নারীকে সন্তান উত্পাদনের যন্ত্র হিসাবেই দেখে ও তার মর্যাদা পরিমাপ করে৷” আলোচনার শেষে এরশাদ নাম এক সহপাঠির সাথে একটু বাক বিতন্ডা হয়েছিল৷ এরশাদের মতে, “ইসলাম নারীকে সব থেকে বেশি সম্মান ও সুরক্ষা দিয়েছে৷” মালিনী সোজা কথায় বলে, “ইসলামিক দেশে নারীর ক্ষময়াতন আর মৌলিক অধিকার আদৌ আছে কিনা একবার স্টাডি কর৷ তাহলে তোর কথার বৈধতা নিজেই যাচাই করতে পারবি৷ তোর ইসলামের কাছে নারীসমাজ হলো মুরগির ফার্ম৷”
বইটি নিয়ে রিডিং রুমে পড়তে থাকে মালিনী৷ যে অংশটি তার নজর কারে তা হলো ‘মিথলজি’৷ পড়ে আর ভাবতে থাকে কি ভাবে প্রাচীন সময়ের মানুষ অতিলৌকিক শক্তি আর ঘটনাবলির সহজ অথচ তাদের সময়কার মতন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়ে মৌখিক আদান প্রদানের মাধ্যমে একটি নিরবিছিন্ন চিন্তার জগত নির্মান করেতো৷ নমো পরিবারে মতুয়া আদর্শে বেড়ে উঠতে উঠতে মতুয়া মিথলজির কিছু কিছু উপাখ্যান শুনেছিল৷ ওর বাবা একদিন বলেছিল, “সেই প্রাচীন কালে নমস নাম এক মুনি ছেল; সেই আমাগে আদি পুরুষ৷ আমরাও বাওন ছেলাম, পরে যে কি কি হইয়্যে গেল...”―বলতে বলতে ভাবে বিভোর হয়৷ মালিনী অবশ্য তেমন উত্তর দেয় না, কিন্তু এই পৌরানিক গল্পের মধ্যে যে একটা কালচারাল উপনিবেশবাদ আছে তা বেশ বুঝতে পারে এবং মুখার্জি চ্যাটার্জি ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী দের কাছে ‘চাঁড়ালের বাচ্চা’ জাতীয় বিশেষণ তার সমাজ কে শুনতে হয়, যেটা ওই উপনিবেশবাদেরই একটা উদাহরণ―সেটাও তার কাছে খুব পরিস্কার৷ শুধু মনের মধ্যে একটা দৃঢ় প্রতয় উদয় হয়―“যে নিজের জাতির ইতিহাস জানেনা, সে মৃত৷” 
সেটা অনেক বছর আগের কথা৷ নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় অভিজিত ব্যানার্জি নাম এক ইতিহাসের শিক্ষক তারই এক সহপাঠিকে ‘চাঁড়ালের বাচ্চা’ বলে অপমান করেছিল৷ বিষয় টা ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন৷ বিপ্লব বালা নাম সেই সহপাঠি বলেছিল, “লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করে ঠিক করেছিল৷” শোনা মাত্রই শিক্ষক রেগে আগুন৷ কোনো রাখঢাক না করেই গোটা ক্লাসের সামনে বিকৃত স্বরে তাকে বলেছিল, “শালা চাঁড়ালের বাচ্চা, ইতিহাসের জানিসটা কি, হ্যা?” ঘটনাটি এতদূর গড়িয়েছিল যে ওই ব্যানার্জি শিক্ষককে স্থানীয় মেমারি শিমুলতলা হরি–গুরুচাঁদ মতুয়া সংঘের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল৷  
সেদিনের মত পড়া শেষ করে বই জমা দিয়ে বেরিয়ে আসে৷ কলেজ স্কয়ারে এক বান্ধবীর সাথে দেখা করবে বলে রওনা দেয়৷ বিশাল বুক জুড়ে যে সুইমিংপুল, তার অগুন্তি ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে সম্ভবত ভাবতে থাকে মিথলজির গল্পগুলো৷ তখন প্রায় ছয়টা বাজে৷ জুন মাসের অপরাহ্ন বেলা৷ কাছাকাছি কলেজ অফিস ইত্যাদির কর্মচারীরা সেখানে এসে একটু পায়চারী করে৷ মালিনী যেখানে জলের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে ছিল তার ঠিক মিটার দুই দূরত্বে তিন জন লোকের মধ্যে চলা কিছু কথাবার্তা কানে এলো৷ যা শুনলো তার সারমর্ম এই― হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিনে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হলো মতুয়া তোষণ নীতি যা মুসলিম তোষণ নীতির সমান৷ তবে একজন ব্যক্তির কথা কান পেরিয়ে, মস্তিস্ক পেরিয়ে মনের অনেক গভীরে যেখানে সব অপছন্দগুলো জমা হয় সেখানে পৌছালো― “আর কত চাঁদ গিরি দেখব৷ শালা নিচু জাত, আবার ঠাকুর হয়েছে!!!!!!!!!” 
ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনচেতা মালিনী যদিও সেই অর্থে প্রতিবাদী নয়, কিন্তু প্রায় পাঁচ ফুট তিন উচ্চতার সুশ্রী, মার্জিত আর ইংরাজি শিক্ষিত আধুনিকা হিসাবে ফেমিনিস্ট ডিগনিটি বজায় রেখে চলে৷ একটু অগোছালো, অনিয়ন্ত্রিত হলেই ছেলেদের প্রেম নিবেদনের চলচাতুরী আর অসভ্যতামী দৈনন্দিন জীবন কে দুর্বিসহ করে তুলবে৷ তাই পাবলিক প্লেসে তারই বয়সী এক ছেলের মত খোলাখুলি তর্ক বা বাকবিতণ্ডা করতে পারে না৷ কিন্ত এই ঘটনায় প্রতিবাদ করা উচিত বলে সে মনে করলো৷ আর যাই হোক, তার সময়ের মেয়েরা বছর পনেরো আগের মেয়েদের থেকে অনেক বেশি সাহসী ও প্রগতিশীল৷ 
মালিনী একটুখানি এগিয়ে গেল৷ একটু গম্ভীর আওয়াজে নিজের জাতির আত্মমর্যাদার পক্ষ নিয়ে বলল, “আমি আপনাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম৷” এই নতুন সংযোজনে তিন ব্যক্তি ঘুরে তাকালেন৷ মালিনী একটু থেমে কিছুটা দম নিয়ে শুরু করলো, “আমার মনে হলো কিছু বলা দরকার, তাই৷ বলছি একটি জাতিকে বা তাদের মহাপুরুষদের বাজে বাজে কথা বলার আগে একবার সেই জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় বিশ্বাস জানুন৷” মালিনী বুঝতে পারছিল তার রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়েছে, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গিয়েছে, আর হাতের আঙ্গুল একটু কাপছে৷
একটি মেয়ের এইরকম অনুপ্রবেশে সেই তিন মেরিটধারী বাবুরা একটু অস্বস্তিতে পরেছিল আরকি৷ একজন সামাল দিতে বলে উঠলো, “না না মামনি, আমরা সেই রকম কিছু বলিনি, মানে...৷” মালিনী সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ তুলল “আমি শুনেছি তো―চাঁদগিরি, নিচুজাত৷ আপনাদের সাহস হয় কি করে একজন ধর্মপ্রবক্তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করার৷ নাকি মনুসংহিতা আর পরিবার আপনাদের এইসব ভাষা শেখায়?” 
এই রকম পরিস্থিতি তার সামনে এখনো আসেনি যে তিনজন পরিনত বয়সের পুরুষের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক করবে৷ এই ব্যাপার নিয়ে তাই আর অগ্রসর হলনা৷ যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানেই সুইমিং পুলের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইল৷ সে নিজের বুকের ধুকপুকানি এবার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল, আর তার হাটু কাপছিল৷ 
মেমারি গার্লস হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতা চলে আসে উচ্চ শিক্ষার জন্য৷ তখন থেকেই বালিগঞ্জে পেয়িং গেস্ট, সঙ্গে আরো দুই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী৷ স্নাতকোত্তরে নৃতত্ত্ব বিদ্যা নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলপুর ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়৷ এবার স্নাতকোত্তরের শেষ বর্ষে থিসিস লেখা শুরু করে মালিনী৷ থিসিসের নাম দেয় “এন ইন্ট্রোডাকসন টু মতুয়া মিথলজি৷” এই গবেষনার পর্যবেক্ষক ড. শ্রীপতি ঘোষ৷ গবেষনার প্রস্তাবটি নিয়ে প্রথম বার মালিনী আলোচনা করে তার পর্যবেক্ষকের সাথে৷ 
“তুমি মতুয়া মিথলজি কোথা থেকে পেলে?”, ড. ঘোষ গবেষনার প্রস্তাবনাটি উল্টে পাল্টে দেখছিলেন৷ এবার মুখ তুলে তাকালেন৷ প্রায় পঞ্চাশের উপর বয়স; চুলে একটু পাক ধরেছে; গোলগাল মুখ; নাক বেশি উচু নয়; ভ্রু বেশ গাঢ়; মধ্যপ্রদেশের ব্যাপ্তি বেশ বড়৷ মালিনীকে বললেন, “যদি মিথলজি নিয়ে কাজ করতেই হয়, তাহলে ট্রাইবাল সোসাইটির মধ্যে সাঁওতাল মিথলজি নিয়ে কাজ করতে পারো৷ মতুয়া ব্যাপারটা অতটা খাটবে না বলে মনে হয়৷ তুমি কি ভাবে ভেবেছ?” 
মালিনী বেশ গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলো, “স্যার, যে কোনো সংগঠিত ধর্মের যেমন নিজস্ব দর্শন থাকে, তেমনি কাল্পনিক বিশ্বাসও থাকে, বিশেষ করে সেই অনুগামীদের নিজস্ব...৷” মালিনী কে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন, “হ্যা সেটা ঠিক আছে, কিন্তু মতুয়া যে সংগঠিত ধর্ম, এটা তো বিতর্কিত৷ বৃহত্তর হিন্দু পরিচয়ের বাইরে এখানে কিছু আছে কি?” মালিনী উত্তর দিল, “এর অ-বৈদিক দর্শন, স্যার৷ সেটা অন্যান্য অবৈদিক দর্শনের যেমন বৌদ্ধ বা চার্বাক এর মত শুধু বস্তুবাদী তা নয়, এখানে গার্হস্থ্য জীবন-যাপনকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে,” মানিলি একটু থামল৷ ড. ঘোষ জিজ্ঞাসা করলো, “বুঝলাম, দর্শনের দিকে যদি যাই, তাহলে অবতারবাদ সম্পর্কে মতুয়ার মতামত কি?” মালিনী সঙ্গে সঙ্গে বললো, “স্যার, সেটা আরোপিত৷” 
“কিন্তু তোমার প্রাইমারি টেক্সট কি সেটা বলছে?” 
মালিনী একটু থেমে কিছু ভেবে বোঝানোর চেষ্টা করলো, “আপনি যদি দেখেন বুদ্ধকে কি ভাবে অবতারবাদ-এ ফেলে হিন্দুকরণের চেষ্টা করা হয়েছে, তাহলে বোঝা যাবে সেই একই রকম ভাবে একটি প্রতিবাদী মতবাদকে দমন করার জন্যই হরিদাস বিশ্বাসের জীবনকে অবতারবাদে মুড়ে ফেলার জন্য কিন্তু ব্রাহ্মণ্যসমাজ সেই হিন্দুকরণ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে৷”
ড. ঘোষ প্রস্তাবনা উল্টে পাল্টে দেখে একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “দেখো, আমার মনে হয় তুমি মিথলজি ছেড়ে বিশুদ্ধ নৃতত্বের দিকে মন দাও৷ আমায় ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ হয় নি৷”
বালিগঞ্জের ঠিকানায় ফিরে মালিনী একটু ভাবতে বসলো৷ বার বার প্রশ্ন করলো: সত্যি কি ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করা যেত না!!! আবার ভাবছে: স্যার কি জেনে বুঝেই বাতিল করলো!!! মনে নানান প্রশ্ন এপাশ থেকে ওপাশ প্রবাহিত হতে লাগলো৷ একটু মানসিক অশান্তি আর কি৷
পরের দিন ড. ঘোষের একটা মেসেজ এলো৷ তাড়াতাড়ি একটা বিষয় নির্বাচন করে লেখা শুরু করতে বলেছেন৷ মানিলীও দেরী করলো না৷ ড. জেমস ওয়াইজ আর স্যার হার্বার্ট হোপ রিসলে লিখিত মূল্যবান এথনোগ্রাফিতে চন্ডাল বা নমো জাতিগোষ্ঠির যে যে বর্ণনা আছে, তাই নিয়ে একটি বিষয় ঠিক করলো “ফ্যাক্ট এগেইনস্ট ফিকসন: এথনোগ্রাফি অফ চন্ডালস ইন ব্রিটিশ আর্কাইভস৷” 
এই বিষয়ে তাকে প্রথম পরিচিত করায় অবনী মালাকার, সম্পর্কে তার এক আত্মীয়৷ তিনি গোবরডাঙ্গা থাকেন৷ সে বার ঠাকুরনগরে বারুণী মেলা উপলক্ষ্যে প্রথম আলাপ হয়েছিল৷ ওর বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, “অবনী, তুমি তো ওরে এহেবারে ছোটবেলা থাকতি দেখছ৷ ও আমার মালিনী৷ এহন কলেজে ফরে৷” মালিনীকে বলে, “সোনা, উনি তোমার এক কাগা হয়৷” কথায় কথায় জানতে পারে যে মালিনী নৃতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে কলেজে পড়ছে৷ তখন উনি বলেন যে, ব্রিটিশের সময়ে জনগননা ছিল একটা বিপ্লব৷ তখনি প্রথম জানতে পারা যায় এই দেশ হিন্দু পরিচয়ের নামে কত হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত আর অল্প জনসংখ্যা নিয়েও কেমন করে সব কিছুতে ব্রাহ্মন উপরে৷ তিনি মালিনীকে বেশ গম্ভীর স্বরে বলেন, “বুঝলে মামনি, জনগণনার রিপোর্ট গুলি হলো সবথেকে মূল্যবান৷ ওখানেই তুমি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির সঠিক ইতিহাস পাবে৷ বামুন কায়েতের বই পরে কাজ নেই৷”
মালিনী তার থিসিস লিখতে শুরু করে৷ তার স্যার কে জানায় সব কিছু এবং কাজে মন দেয়৷
একদিন রাতে অন্তরা চক্রবর্তী নাম ওর এক সহপাঠি ফোন করলো৷ 
“এই মালিনী, বলছি মতুয়া ধর্ম নিয়ে আমাকে কিছু বইয়ের নাম বল না! খুব দরকার৷”
“তুই থিসিস টা কি মতুয়া নিয়ে লিখছিস?”
“হ্যা”
“তোর গাইড কে?”
“শ্রীপতি স্যার”
“ও তাই!!”
“বলছি, তুই আমাকে একটু বুঝিয়ে দিস আর কি কি বই আছে দুই এক দিনের মধ্যে বলিস৷”
“ঠিক আছে, রাখছি৷”
সেদিন সারারাত মালিনী চোখের পাতা এক করতে পারল না৷ ঠিক মত খেতে পারল না৷ মা ফোন করেছিল, কথা বলল না৷ ঘুমোতে যাবার আগে ব্রাস করলো না৷ এলোমেলো চুলে ঘুমিয়ে পরার ভান করলো, আর চুপচাপ ভাবতে লাগলো: “ব্যাপার টা কি দাড়ালো? স্যার আমাকে মতুয়া নিয়ে কাজ করতে বারণ করলো, আর অন্তরা কে বলল মতুয়া নিয়ে কাজ করো!!!!” হিসাব টা কিছুতেই মিলছে না৷ এই রকম পক্ষপাতিত্তের কারণ কি? মনে মনে ঠিক করলো, স্যার কেই সরাসরি জিজ্ঞাসা করবে৷
পরের দিন ওর থিসিসের ব্যাপার নিয়ে কথা বলবে বলে ইউনিভার্সিটি রওনা দিল৷ মালিনী মনস্থির করে রেখেছিল যে এই ব্যাপার টা নিয়ে সে কথা বলবেই৷
সিড়ি দিয়ে ওঠার মুখেই দেখে অন্তরা বেরিয়ে আসছে৷ মুখে বেশ একটা স্বস্তির ভাব৷ মালিনিকে দেখে বলল, “কখন এলি? স্যার তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল৷”
“তাই? তোর কাজ হলো?” 
“হ্যা, একটু আলোচনা করলাম৷ এই, বলছি আমি তোকে পরে বলব সব৷”
“ঠিক আছে,” মালিনী একটু মুচকি হাসলো কিন্তু বুঝতে পারল সব৷
মালিনী সোজা ওর স্যারের সাথে দেখা করলো৷ মানিলিকে দেখে ড. ঘোষ বসতে বললেন৷ ওর নতুন প্রস্তাবনার খসড়াটা দেখে বললেন, “তুমি যে বিষয়টা চয়েস করেছো সেটা আমার কাছে খুব নতুন মনে হয়েছে৷ এই রকম ভাবে সেনসাস রিপোর্ট আর কলোনিয়াল আর্কাইভ ঘেটে একটি জাতির ইতিহাস, নৃতত্ত্ব খুব একটা কেউ মাস্টার ডিগ্রী তে করে না৷ গ্রেট চয়েস৷”
“স্যার আমি একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চাই৷” মালিনী পরিস্কার করে শুরু করলো৷ 
“আমি জানি তুমি কি নিয়ে কথা বলতে চাও৷” একটু মুচকি হাসিতে বললেন৷ 
“তাহলে আপনি বলুন, যেটা আমাকে করতে বারণ করলেন, সেটা অন্তরা কে করতে বললেন কি ভাবে? আপনার কি এটা মনে হয়েছে যে অন্তরা মুখার্জি মতুয়া নিয়ে যে কথা গুলো বলতে পারবে বা যে চিন্তা গুলো তুলে ধরতে পারবে, সেটা মালিনী বিশ্বাস পারবে না? আমি কিন্তু ডিপার্টমেন্টের টপার৷”
ড. ঘোষ একটু বিচলিত হলেও মালিনিকে একটি কথায় বললেন, “দেখো, গাইড আমি৷ আমি কাকে কোন বিষয়ে কি করতে বলব সেটা নিয়ে না ভেবে তুমি বরং তোমার কাজ কর৷”
“বুঝেছি স্যার৷” 
মালিনী একটু খানি থেমে বেশ প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল৷ তারপর নিজের মতামত ব্যক্ত করলো, “এটা রামমোহন-বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ, রবীন্দ্র-নজরুলের সোনার বাংলা তো!! এখানে শুধু কলকাতার নবজাগরণের গল্প চলে, আর একটু বেশি হলে হিন্দু মুসলমান৷ কিন্তু আমি আজ বুঝতে পারলাম, আরো একটা ব্যাপার এখানে চলে গোপনে গোপনে৷ সেটা হলো “মুখার্জি বনাম মন্ডল/বিশ্বাস”-দের একটা “কালচারাল ওয়ারফেয়ার৷” আমি একটা কথা আপনাকে বলছি, পি.এইচ.ডি তে আমি “মতুয়া থিওলজি ও মিথলজি” নিয়ে গবেষণা করবই৷ আসছি স্যার৷”
মালিনী বেরিয়ে এলো৷ এবার সে অনুভব করতে পারল তার বুকের ধুকপুকানি আর করছে না, হাতের আঙ্গুল গুলো কাঁপছে না, হাটুতে দুর্বল লাগছে না আর মনের ভিতর একটা সাহস আস্তে আস্তে আবছা কুয়াশা থেকে ক্রমশ জমাটবাধা স্তরীভূত মেঘের মত এক দৃশ্যমান ব্যক্তিত্বের চেহারা নিচ্ছে৷