click on images to know more about the Images
‘তিতাস একটি নদীর নাম ’-একটি আঞ্চলিক উপন্যাস। তিতাস’বর্তমান বাংলা দেশের কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণ বাড়িয়া (বর্তমানে জেলা) শহর থেকে তিন চার মাইল দূরে বয়ে চলা একটি মাঝারি নদী। এই নদীর তীরে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম ‘গোকর্ণঘাট । গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ মালো সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। ‘মালো’ সম্প্রদায় দলিত তপশিলি জাতি। লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিজেও এই মালো সম্প্রদায়ের মানুষ। মালোরা মৎস্যজীবী। তিতাস নদীর মাছ ধরে বিক্রি করে তাদের সংসার চলে। নৌকা এবং মাছ ধরার জাল তাদের নিত্য সঙ্গী। উপন্যাসটি চারটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে দুটি উপকাহিনী। যেমন - প্রথম অধ্যায়ঃ ১। তিতাস একটি নদীর নাম।, ২। প্রবাস খন্ড দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ১। নয় বসত। ২। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ তৃতীয় অধ্যায়ঃ ১। রাম ধনু। ২। রাঙা নাও চতুর্থ অধ্যায়ঃ ১। দুরঙা প্রজাপতি। ২। ভাসমান।
প্রথম অধ্যায়ের প্রথম উপকাহিনী তিতাস একটি নদীর নাম’অংশে তিতাস নদীর বর্ণনা রয়েছে।‘তিতাস’ বাংলাদেশের বিখ্যাত মেঘনা নদীর একটি শাখা নদী। এই নদীতে মাছ ধরে মালো জাতির লোকেরা কী ভাবে জীবন যাপন করে, তারই বর্ণনা রয়েছে এই অংশে। আর দ্বিতীয় উপকাহিনী ‘প্রবাস খন্ডে’ রয়েছে। কিশোর ও সুবল নামের দুটিমালো সম্প্রদায়ের ছেলের বিদেশে যাত্রার কথা। তারা বেশী পয়সা উপার্জনের জন্য নৌকা নিয়ে মেঘনা নদীর পাড়ে শুকদেব পুরে চলে যায়। এবং ফেরার সময় ওই গ্রামের একটি মেয়েকে বিয়ে করে কিশোর। কিন্তু ফেরার পথে ডাকাতে তার বউকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। যা দেখে কিশোর পাগল হয়ে যায়।।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম উপকাহিনীর নাম ‘নয়াবসত। এই অংশে জানা যায় কিশোরের বউ মরে নাই। নদীর জলে অজ্ঞান হয়ে ভেসেছিল। দু’জন ব্যক্তি তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। কিশোরের বউ এর পেটে বাচ্চা ছিল। প্রবাস খন্ডের চার বছর পরের কথা। কিশোরের ছেলেটির নাম অনন্ত। অনন্ত-র মা অনন্ত কে নিয়েগোকর্ণ ঘাট গ্রামে আসে। নতুন করে বসত ভিটে কিনে বাস করতে থাকে। সে তার স্বামীর নাম এবং স্বামীর বন্ধুর নাম কিছুতেই মনে করতে পারে না। সুবল গ্রামেরই মেয়ে বাসন্তীকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু সুবল মারা যাওয়ার পর বাসন্তীকে সবাই সুবলা’র বউ বলে ডাকে। পাশের গ্রাম ‘যাত্রা বাড়ির মাব্বর রাম প্রসাদ গোকর্ণ গ্রামে বিচার করতে আসে এবং অনন্তর মাকে (কিশোরের বউ) প্রস্তাব দেয় যাত্রাবাড়ি গ্রামে গিয়ে বাস করতে। কিন্তু অনন্তর মা গেল না। জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ’ অংশে রয়েছে বিচিত্র সব ঘটনা। অনন্তর মা কিশোরকে চিনতে পেরে ধীরে ধীরে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। সুবলা’র বউ তা নিয়ে মস্করা করলেও পরবর্তীতে সহানুভূতি দেখায়। অনন্তর মা পাগলকে সুস্থ করে তাকে নিয়ে সংসার করার স্বপ্ন বুনতে থাকে। হোলির দিনে অনন্তর মা পাগলকে রঙ মাখাতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে। পাগল অনন্ত’র মায়ের বুকে মুখ ঘষতে থাকে। অনন্ত’রমা ভয়ে ও লজ্জায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললে গ্রামের লোকে পাগলকে প্রচন্ড মারধর করে। ফলে কিশোর পাগল মারা যায়। আর প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চার দিন পরে অনন্ত’র মা মারা যায়।
তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম অংশ ‘রাম ধনু’। এই পর্বে দেখা যায় - সুবলা’র বউ (যাকে অনন্ত মাসী বলে ডাকত) বাপ মায়ের সাহায্যে এবং তার বাপের বাড়িতে থেকেই অনন্ত’র মায়ের শ্রাদ্ধ করল। তার পর একদিন বিশেষ পরিস্থিতির চাপে সুবলা’র বউ অনন্তকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। ওই গ্রামের ‘উদয়তারা নামের একটি বউ যখন তার দাদা বনমালীর সাথে দাদার বাড়ীতে গেল।তখন সঙ্গে নিয়ে গেল অনন্তকে। বনমালীর বাড়িতেই অনন্ত একটু একটু করে বড় হতে লাগল জীবনের নানা রঙ দেখতে দেখতে। বনমালীর পরিচিত এক সাধু তাকে স্কুলে ভর্তি করার আশ্বাস দিল। একদিন বনমালির গ্রামের ‘অনন্তবালা’ নামে একটি মেয়ে অনন্ত’র গলায় শাপলার মালা পরিয়ে দিলে সেও (অনন্ত) মেয়েটির খোঁপায় মালাটি পরিয়ে দিল। হয়ত মেয়েটি মনে মনে অনন্তকে ভালোবেসে ফেলেছে। রাম ধনুর সাত রঙের মতোই অনন্তর জীবনে নানা রঙের মেলা বসে গেল।
তৃতীয় অধ্যায়ের ‘রাঙা নাও’ পর্বে ‘নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন বর্ণনা করা হয়েছে। বনমালী ও তার বোন উদয়তারার সাথে অনন্ত ও অনন্তবালা নৌকা বাইচ দেখতে এসেছে। আবার গোকর্ণ ঘাট গ্রাম থেকে এসেছে সুবলা’র বউ। তাকে দেখেই অনন্ত মাসি বলে ডাক দেয়। সুবলা’র বউ অনন্দকে দেখে আদর করতে গেলে উদয়তারা ও সুবলা’র বউ -এর মধ্যে মারামারি হয়। অনন্তকে এক দিন তাড়িয়ে। দিয়ে ছিল সুবলার বউ। সেই অভিমানে অনন্তও সুবলার বউ-এর থেকে চিরতরে দূরে থাকতে চায়। তাই সুবলার বউ মনে করে এই পৃথিবীতে সে একা কেউ নেই তার।
আসলে অনন্তকে সে গভীরভাবে ভালো বাসত। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে সে অনন্তকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্ত মন থেকে কোনো দিনই তাড়াতে পারেনি। প্রচন্ড মার খেয়ে সুবলার বউ বাড়ি ফিরে লজ্জায় নিজেকে বাড়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখে। পাড়ার লোকে নানা রকম সমালোচনা করতে থাকে। সুবলার বউ তীব্র প্রতিবাদে গর্জে ওঠে। সঙ্গে যোগ দেয় মালোপাড়ার ছেলেরা। তারা কায়েতের ছেলেদের মারধর করে। ফলে কায়েত পাড়ার লেকেরা মালোদের চরম সাজা দেওয়ার। প্রস্তুতিনিতে থাকে। বামুন কায়েতের টাকা আছে। মালো পাড়ার ছেলেরা তাদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয় জাল, নৌকা গড়বার জন্য। মালোদের নিজস্ব সংস্কৃতি ছিলো। বামুন কায়েতেরা সেই সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে মলোদের একতা নষ্ট করে তাদের দুর্বল করে দিতে চাইল। তাই তারা তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রাপালা অভিনয় -এর মাধ্যমে অধিকাংশ মালো ছেলে-মেয়েদের আকৃষ্ট করে ফেলল। মালোরা হারাতে থাকল তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও একতা। এই ধ্বংস মেনে নিতে পারল শুধু প্রতিবাদী মানসিকতার সুবলা’র বউ ও মোহন মালো।
অন্যদিকে অনন্ত বনমালীর বাড়ীতে থেকে সাধুর কাছে শিশু শিক্ষা ও বাল্য শিক্ষার বই সমাপ্ত করল। অনন্ত’র রামায়ণ পড়া শুনে মুগ্ধ হয়ে এক নাপিতানি তাকে উৎসাহ দিল গ্রাম ছেড়ে কুমিল্লা শহরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। এবং সত্যিই একদিন অনন্ত আবার অজানা কে জানবার উদ্দেশ্যে পথে পা বাড়াল।
ভাসমান - পর্বের বর্ণনায় দেখা যায় - তিতাসের বুকে চর জেগেছে। দুরের চাষিরা চর দখল করে ধান চাষ করে। মালোরা জীবিকা হারিয়ে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। উদয়তারা আবার স্বামীর ঘর করতে আসে। সুবলের বউয়ের সাথে তার আবার ভাব হয়ে যায়। অনন্ত কুমিল্লা শহরে এসে বি.এ.পাশ করে। একদিন কুমিল্লা শহরে বনমালীর সাথে দেখা হলে অনন্ত বনমালী, উদয়তারা এবং সুবলের বউয়ের জন্য কাপড় কিনে দেয়।
এই সময় অনন্ত এক কায়স্থের মেয়ের প্রেমে পড়ে। কিন্তু সে মেয়ে তাকে প্রতারণা করে। তাই সে বাউন্ডুলে হয়ে পরোপকার করে বেড়ায়। কাদির মিঞা তার গোলা ভরা ধান বিলিয়ে দেয় দরিদ্র মালোদের জন্য। তবু তিতাস পাড়ের মালোরা একদিন চিরতরে হারিয়ে যায়। শেষ হয় তিতাসের গল্প।