click on images to know more about the Images

স্মৃতি

Author: দীপ কমল বাউরী

* গল্পের চিত্রকরণ – পিন্টারেস্ট, সুজিত সিরকার পরিচালিত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ অক্টোবর ‘।

* গল্পে ব্যবহৃত গানের লিরিক্স রাইটার্স – আর.ডি.বর্মন – শচীন ভৌমিক, মহতিম শাকিব,  জিসান খান শুভ।

 

প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন, বিকেল বেলা বাজার করতে বেরিয়েছি। কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলাম। ফেরার পথেই পড়ে আমার ছোটো বেলার স্কুল। পার হতে হতে- দেখছি,স্কুলটাকে বেশ সাজানোহয়েছে। আর অল্প সাউন্ডে বাজছে ‘ মনে পড়ে রুবি রায়’। স্কুলের পাশ দিয়ে পার হতে হতেই, স্কুলের সামনে আমাদের অমলেন্দু বাবুকে দেখে একটু দাড়ালাম। বেশ কিছুক্ষণ কথা হল। কথা বলার পর স্কুল চত্বর টা একটু ঘুরে দেখলাম। অনেক পাল্টে গেছে দেখছি । খেলার সময় পড়ে গিয়ে যে মাঠে বহুবার নিজের হাত – পা ছুলিয়েছি। সেই মাঠে আর এবড়োখেবড়ো পাথর নেই। পুরো সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ । রুমের দেওয়াল গুলোতে আর কারো নাম লেখা নেই।ঢুকলাম স্কুলের হল ঘরে,যেখানে অনুষ্ঠান হয়। দেখলাম একদল ছেলে রুম সাজা সাজি করছে। একসময় আমরাও এই কাজটা করেছি।এদের কে দেখে মূহুর্তের মধ্যে স্কুল জীবনের অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে এল। বিশাল এর সাথে টিফিন শেয়ার করে খাওয়া, হিমাদ্রির সাথে অযথাই মারামারি করা, শুভাশিস এর ভাইকে ওর রুমে গিয়ে রাগানো, অনিত্য স্যার এর ক্লাসে মহেশের বাঁদরামি, আরো অনেক কিছু। এদের সাথে সাথেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল লাল ফিতে মাথায়, কাজল টানা চোখে, বিনুনি করা চুলের এক সরল,নিস্পাপ হাসিতে ভরা মুখ -   রিজিয়া।

 

 
 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সে সাত বছর আগের কথা। তখন আমি একটা রিলেশন এ ছিলাম । বয়স তখন আমারষোলোআর ওর আমার থেকে এক বছর কম হবে হয়তো? সময়টা ছিল ঠিক আজকের দিনের । নবম শ্রেণীতে পড়তাম তখন আমি। স্কুলের প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের দায়িত্ব টা প্রধান শিক্ষক আমাদের ক্লাস কেই দিয়েছিল। ২৬ শে জানুয়ারির আগের কয়েকটা দিন বেশ ব্যস্ত ছিলাম। তাই ওর সাথে দেখাও হয়নি, আর কথাও হয়নি। ২৬ শে জানুয়ারির আগের রাত্রি টা আমরা বন্ধুরা সবাই স্কুলেই কাটাবো বলে ভেবেছিলাম। এরকমেও মাঠ সাজানো, বনমালা টাঙানো,এছাড়াও আরও অনেক  কাজ, যেগুলো রাত্রি বেলা সব আমাদেরই করতে হতো। তাই সেই রাতটা স্কুলেই কাটাবো বলে ঠিক করেছিলাম। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আমরা সবাই একসাথে রাতের খাবার টা সেরে, বনমালা বানানোর কাজ শুরু করেছি। এমন সময় হঠাৎ করে আমার মোবাইবাইল টা বেজে ওঠে । দেখি একটা অজানা নাম্বার। রিসিভ করে যখনই বলি –‘কে বলছেন’? ওদিক থেকে উত্তর আসে –‘ আরে, আমি রিজিয়া বলছি।‘ এটা আমার বাড়ির নাম্বার ,তাই এই নাম্বার আমি ওকে দিইনি। সেদিন স্কুলে রাত কাটাবোবলে, মাকে কোনো মতে রাজী করিয়ে মোবাইলটা নিয়ে আসি।এই মোবাবাইলের নাম্বার টা জানি না  কোত্থেকে জোগাড় করেছে সে? হয়তোকোনো বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছে।

 

রুমের বাকি ছেলেগুলো একটু হইহল্লা করে কাজ করছিল। মোবাইলের কথা গুলো শুনতে অসুবিধা হচ্ছিল। আমি সোজাসুজি স্কুলের ছাদে উঠে ,জলের টাঙ্কির উপর বসে পড়ি । আর বলি –‘ হ্যাঁ বল।‘ ও বলল –‘তোকে কদিন ধরে দেখতে পাইনি তাই ফোন করলাম।‘ আমি ওকে খুলে বলি যে প্রজাতন্ত্র দিবসের কাজের জন্যই আরকি, এরকম। এভাবে কয়েক ঘন্টা কথা বলার পর হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, যে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি? এরকম প্রশ্ন শুনে আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। তবুও বললাম যে, কাউকে দেওয়ার মতো আমার কাছে যতটুকু ভালোবাসা আছে। সেই পুরােটাই আমি তোর জন্য রেখেছি। ওদিক থেকে রিপ্লাই এল , ‘পুরোটাই আমার জন্য। আমি নির্বিঘ্নে বললাম ‘ হুমম ‘| আমার কথা শুনে ও আমাকে বলল যে –‘এখন তোকে সামনে থেকে দেখতে অনেক ইচ্ছে করছে।‘ ওর এই অপূর্ণ ইচ্ছে আমার চোখেও একটা অসম্পূর্ণ না পাওয়ার কাতরতা দিয়ে গেল। তারপর ফিসফিস করে –‘মা আসছে, গুড নাইট’ বলে ফোনটা কেটে দিল।

 

 

শীতল বাতাস আলগা হয়ে গায়ে লাগছে । আকাশে দেখা দিয়েছে চাঁদ,বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য নক্ষত্র। স্কুলের মাঠ- বাগান, কেমন যেন আলোময় হয়ে উঠেছে চাঁদের কিরণে। একা আমি ঐ আকাশের চাঁদের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি । শীত মাখছিল আমার চোখ, মুখ আর গোটা শরীর।আর নীচ থেকে ভেসে আসছিল বক্সের সাউন্ড - .

ইচ্ছে করে একটা ঘরে থাকবো দুজনায়,

গড়বো ভিটে খুশির ইটে সঙ্গী হবি আয়।

কলের পাড়ে জলের ধারা ঘরের পরে তুই,

চারটে হাতে খেলনা পাতে একজোড়া চড়ুই।

 

 এর সাথে সাথেই আমার মন এক দুর্বল স্বপ্নের জাল বুনে চলেছিল,যার দৃঢ়তা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল সমাজের নির্দয় চোখের কাছে । সেই স্বপ্নের কল্পনায় নিজেকে ভাসাতে ভাসাতে, ঠোঁটের কোনায় একটা কেমন প্রেমময় শান্ত হাসি স্থান পেয়েছিল ক্ষনিকের জন্য।

 
 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

নীচ থেকে শুভাশিস হঠাৎ ডাক দিয়ে বলল, - ‘ ঐ একা একা কি করছিস? নেমে আয় অনেক কাজ বাকি আছে।‘ ওর কথায় নেমে এসে সমস্ত কাজ সেরে , শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চোখে আর ঘুম নেই। গোটা দিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে শরীরে ক্লান্তি এসেছে, তবুও দুচোখে ঘুমের বিন্দুমাত্র হ্রদিশ নেই। হয়তোকোনো মায়াবি চোখের কাজল আমার দুচোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। একটা অস্থির হৃদয় নিয়ে আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি । ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে,আমি ওকে কতটা ভালোবাসি? আর আমিও ওকে বলেছিলাম , যে আমার পুরো ভালোবাসা টাই তোর। তবুও আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল। সেই রাতে নিদ্রার দেখা নেই। বার বার ঘুমমাখা চোখের সামনে উঁকি দিচ্ছিল এক নিদ্রাহারিণী অপরুপা। যার দুচোখের কাজল কোনো এক মেঘাচ্ছন্ন বৃষ্টিমুখর রাতের লোডশেডিং এর অন্ধকার কেও হার মানায়। কাশের বনে দোলা লাগানো বাতাসের চেয়েও জোরালো যার শান্ত ঠোঁটের মৃদু হাসি। যার দু পায়ের চঞ্চলতা মাতিয়ে রাখে পাড়ার নৃত্যানুষ্ঠানের মঞ্চ। হঠাৎ করে চোখের পলকে মনে হল,  সেই রুপমাধুরি আমায় নিয়ে নিমেষে গিয়ে বসে পড়েছে  কোনো হাজার বছরের দুর্বল হয়ে আসা এক পাহাড়ি নদীর পুরোনো সেতুর উপর।

 

 

একসাথে অনেক অনেক ছবি , চোখের সামনে রং মাখছে । কখনো রাস্তার মাঝে স্কুল ইউনিফর্ম পরা এক মেয়ে পিছন হতে ডাকছে। কখনো জানালার পাশে বসে আমার অপেক্ষা করছে, একটু দেখবে বলে। কখনো আমাকে টিউশন যেতে দেখে হাত দেখিয়ে ইশারা করছে। কখনো আমার উপর অভিমান করে মুখভার করে বসে আছে। আবার কখনো, আমরা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি প্রহরের পর প্রহর। দেখছি সেই মায়াবিনী কণ্যা কে, যে আমাকে সাথে নিয়ে পাড়ি দিয়েছে এক অচেনা স্বপ্নের জগতে। কোনো এক গভীর জঙ্গলে দেবদারুর ঘন ছায়ায় ডুবে গিয়েছি একে অপরের ঠোঁটে, একে অপরের মাঝারে।

সাত বছর পর , আজ হঠাৎ মনে পড়লো সেই রাতের কথাটা।দুই বছর হলো ওর বিয়ে হয়েছে। দুই বছর ধরে কোনো কথা হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি হয়েছি। ওকে দেখলেই হঠাৎ করে আমার মধ্যে একটা অস্থিরতা চলে আসে।আমাকে দেখে ওর ও যে একটা ভাবভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে সেটাও আমি লক্ষ্য করেছি। ওর মুখের দিকে তাকালেই , কেমন একটা অসহায়তা জন্ম নেই আমার বুকে।যেটা আমার প্রায় দম বন্ধ করে ফেলে।

 

ঘুরতে ঘুরতে উঠে গেলাম সেই ছাদে। বেশ নোংরা হয়ে আছে। সেই পুরোনো জলের টাঙ্কি টা এক সাইডে আলাদা করে রাখা আছে।নেমে এসেছে অন্ধকার। আকাশে উঁকি দিয়েছে চাঁদ। হাজার হাজার নক্ষত্রের মাঝে আমি আবার সেই একই জায়গায় এসে দাড়িয়েছি।হিমেল বাতাস গায়ে লেগে চুপচাপ বুকভার করে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কাঁপছি । আজ ও ঠিক সেই দিনের মতোই চেয়ে আছি আকাশের শীতমাখা ঝাপসা চাঁদের দিকে। শীত মাখছে গোটা শরীর আর নীচ থেকে ভেসে আসছে সেই বক্সের সাউন্ড –

জ্বলে নেভে জোনাকি দিয়ে যায় আলো,

তুই ছাড়া একলা আমি কেমনে থাকি ভালো?

এই ভরা জোছনায় তুই কার পাশে?

কার বুকেতে মাথা রাখিস কারে ভালোবেসে?

কোনো এক নির্জন শীতের সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যেভাবে হারিয়ে যায় দুরের সবুজ । ঠিক সেভাবেই হারিয়ে গেছে  রিজিয়া।সেইকুয়াশামুছেফেলতেদিনেরআলোরদেখানেইআর।
সেদিন ওকে যেটা আমি বলেছিলাম, যে আমার পুরো ভালাবাসা টাই তোর। সেই ভালোবাসাটা এখনও বয়ে চলেছি, বিন্দুমাত্র ব্যায় করে উঠতে পারিনি। কিছু কিছু ভালোবাসা হয়তো খরচ করার জন্য হয় না। সেগুলো হয় ,আজীবন বুকে জমিয়ে রাখার জন্য।